ঈদ ঘিরে আনন্দ নেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারগুলোয়

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হন পেশায় অটোচালক আকাশ। স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে ছিল তার পরিবার। একটি দুই রুমের বাসায় ভাড়া থাকতেন তারা।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হন পেশায় অটোচালক আকাশ। স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে ছিল তার পরিবার। একটি দুই রুমের বাসায় ভাড়া থাকতেন তারা। গত ৫ আগস্ট উত্তরায় রিকশায় করে আহত ছাত্র-জনতাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আকাশ। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা এ পরিবার। সন্তানদের খাবার ও পড়াশোনার খরচ বহন করতে বাধ্য হয়ে ভিক্ষায় নামতে হয়েছে আকাশের স্ত্রী লাকি আক্তারকে। আসন্ন ঈদুল ফিতরের কোনো আমেজ নেই এ পরিবারে।

শুধু লাকি আক্তার নন, প্রায় একই চিত্র জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অনেক শহীদের পরিবারে। গণ-অভ্যুত্থানের পর এটাই প্রথম ঈদ। শহীদ পরিবারের সদস্যরা এখনো স্বজন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। কেউ কেউ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দারিদ্র্যের কশাঘাতে দিন পার করছেন। ঈদ তাদের জন্য আর আগের মতো উৎসব নয়; বরং বেদনার আরেক নাম।

লাকি আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংসার চালাতে পারি না, ঘর ভাড়া দিতে পারি না, দিনের খাবার দিনে জোগাড় করতে পারি না, তাই বাধ্য হয়েই ছেলেকে নিয়ে ভিক্ষা করি।’ ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে শহীদ আকাশের বড় মেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার আব্বু বেঁচে থাকলে এতদিনে আমাদের সব ঈদের বাজার করা হয়ে যেত। এখন আমাদের ঈদের বাজার কে করে দিবে? আমার আব্বু তো নেই।’

আকাশের পরিবার জানায়, মৃত্যুর কয়েকদিন পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সাহায্য-সহযোগিতার কথা বললেও পরে কেউ তাদের আর খোঁজখবর রাখেনি। এমনকি কাগজপত্রের জটিলতায় আটকে আছে জুলাই ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতা। শহীদ আকাশের স্ত্রী বলেন, ‘সন্তানের বাবা বেঁচে থাকলে এতদিনে আমাদের ভরণপোষণ নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। সরকারের কাছে অনুরোধ, যেন আমার পরিবারকে চলার মতো সহায়তা দেয়া হয়।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আরেক শহীদ আব্দুল কাইয়ুম। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএস) বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ৫ আগস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকালে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি।

আব্দুল কাইয়ুমের ভাই মোহাম্মদ কাউসার আহমেদ গত রমজান ও ঈদের স্মৃতিচারণ করে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার ভাই ২০ রমজানে বাড়িতে চলে আসত। এরপর ইতিকাফে বসত। ঈদের আগের দিন বের হতো। আমার মা এসব দেখে আনন্দিত হতেন। তবে এবার আমার ভাই নেই। সে শহীদ হয়েছে। আমার মা প্রতিদিন কাইয়ুমের কথা বলে কান্নাকাটি করেন। এখনো তিনি শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমার ভাইয়ের শোক আমাদের পরিবারের সবার মাঝে বিরাজ করে।’

অভ্যুত্থানে শহীদ হয় ১৬ বছরের কিশোর ইসমাম। গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয় সে। পরে মার যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে ঢাকায় এসেছিল ইসমাম। প্রতি ঈদে মায়ের জন্য শাড়ি নিয়ে বাড়ি যেত। শহীদ ইসমামের ভাই মুহিব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত বছরের আগস্টে আমার ভাই অ্যাম্বুলেন্সে একেবারে ফিরে আসে। এবারের ঈদে সে আর ফিরবে না। মা এখনো দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন এই আশায় যে তার ইসমাম ফিরে আসবে।’

শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর মা কোহিনূর আক্তার আজও বিশ্বাস করতে পারেন না, তার ছেলে মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন আন্দোলনে যাওয়ার জন্য শান্ত তাড়াহুড়া করে টিউশনি শেষ করেছিল। বলেছিল, পরদিন বেশি সময় ধরে পড়াবে। বাসার চাবি সবসময় তার কাছেই থাকত, কখনো কাউকে দিত না। কিন্তু সেদিন যেন অজানা কোনো অনুভূতিতে নিজ থেকেই আমাকে ডেকে চাবি দিয়ে গিয়েছিল। হয়তো বুঝতে পেরেছিল, আর ফিরবে না। পরোটা আর চা বানিয়ে রেখেছিলাম, যেন সন্ধ্যায় ফিরে খেতে পারে। সেই সন্ধ্যা আর এল না।’

তিনি বলেন, ‘ওর লাশ দেখতে যখন নিয়ে যাওয়া হলো তখনো মনে হচ্ছিল, হয়তো ভুল হচ্ছে। গিয়ে দেখব, অন্য কেউ শুয়ে আছে। এখনো মাঝেমধ্যে মনে হয়, শান্ত ফিরে আসবে।’

কোহিনূর আক্তার আরো বলেন, ‘আমার ছেলে রমজানের তারাবি নামাজ কখনো মিস করত না। তারাবি বাদ যাবে এই ভেবে রমজানে কোথাও বেড়াতে পর্যন্ত যেত না। কিন্তু এবার আর তারাবি পড়ার কেউ রইল না। ঈদের আনন্দ সব উবে গেছে। এখন শুধু অপেক্ষা করছি, কবে আমার শান্তর কাছে চলে যাব।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আরেক শহীদের নাম মো. ফারুক। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাইদের মৃত্যুর পর পরই চট্টগ্রামে ফারুক পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিতে নিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শহীদ ফারুক একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতেন। ফারুকের স্ত্রী সীমা আক্তার দুই সন্তান নিয়ে এক রুমের ছোট বাড়িতে বাস করছেন। অভাব-অনটন যেন পিছু ছাড়ছে না। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার স্বামীর কথা কেউ বলে না। কারণ সে ছাত্র ছিল না; শ্রমিক ছিল, ফার্নিচারের দোকানে কাজ করত। আমার বাবা আর ছোট ভাইয়ের সহযোগিতায় কোনোমতে সংসারের হাল ধরেছি। সরকারের সহায়তা না পেলে অসহায় জীবন-যাপন করতে হবে আমাদের।’

আরও