রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০২০ সালের শেষ দিকে অনেকটা ঘটা করেই ওয়াসার কাছ থেকে খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা বুঝে নেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। দায়িত্ব পাওয়ার পৌনে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও খাল দখল ও দূষণমুক্ত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ফলে নানা স্থানে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা এবং খালগুলো পরিণত হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। তীব্র আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গুর মতো নাগরিক ভোগান্তি। এর মধ্যেই আরো ৩০-৩২টি খালের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে ডিএসসিসি। বণিক বার্তাকে সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, দায়িত্ব পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কয়েকটি খালে অনিয়মিত হলেও অভিযান পরিচালনা ও দখলমুক্ত করেছে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পুরোপুরিই ব্যর্থ। দায়িত্ব নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণে জনগণের অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি একটি দুর্যোগপ্রবণ নগরীতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে নতুন খালের দায়িত্ব পেলে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কেবল অর্থেরই অপচয় হবে। এমনকি এসব খাল বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কাও করেছেন তারা।
ডিএসসিসি সূত্র জানিয়েছে, সংস্থাটির নতুন অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডে খাল রয়েছে ৩০-৩২টি। এগুলোর বেশির ভাগই পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানায়। তবে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় কোথাও এসব খাল দখলে আছে, আবার কোথাও বন্ধ রয়েছে পানিপ্রবাহ। তাই ডিএসসিসি চাচ্ছে খালগুলো নিজেদের মালিকানায় নিয়ে সংরক্ষণ করতে। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই শ্যামপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী এলাকার ৩০-৩২টি খালের দায়িত্ব নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে, যিনি ডিএনডি বাঁধ প্রকল্পের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী। জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডিএসসিসির নতুন এলাকার খালগুলো আমরা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের ব্যাপারে কথাবার্তা বলছি। খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মূলত সিটি করপোরেশনেরই। বর্তমানে আমাদের দায়িত্বে থাকলেও এসব মেইনটেইন করার জন্য সে রকম জনবল নেই। তাই আমরাও চাচ্ছি খালগুলো সিটি করপোরেশনের আওতায় নেয়া হোক। এতে খালগুলোও রক্ষা পাবে, জনভোগান্তিও অনেকটা কমে যাবে।’
একটা সময় রাজধানী ঢাকা ছিল খাল-নদীর শহর। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এসব ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণের ফলে আজ ঢাকা দুর্যোগপ্রবণ নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঢাকার হারিয়ে যাওয়া খাল নিয়ে গবেষণা করেছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দূর অতীতে ঢাকার জল যোগাযোগ ব্যবস্থা অতিসুলভ হওয়ার কারণেই মূলত ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করা হয়। স্বাধীনতার পরও ঢাকার জল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুব ভালো। ধোলাইখাল, ফকিরাপুল, পান্থপথ, ধানমন্ডি, মিরপুর এসব এলাকায় নদীসম প্রশস্ত খাল ছিল। সেগুলো এখন সংকীর্ণ হতে হতে কোনো রকম টিকে আছে। অনেক খাল হারিয়েও গেছে। এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকার যানজট কমাতে গিয়ে ভরাট করা হয় একের পর এক খাল।’
আগের খাল সংরক্ষণে ব্যর্থ ডিএসসিসির মালিকানায় নতুন আরো ৩০-৩২টি খাল অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে পরিবেশের এ শিক্ষক বলেন, ‘নতুন যে খালগুলো ডিএসসিসির আওতায় আসছে সেগুলোর পরিণতিও আগের মতো হয় কিনা সে শঙ্কা করছি। আমরা দেখেছি, উন্নয়নের নামে খাল ভরাটের প্রকল্প এখনো নেয়া হচ্ছে। তাই আমাদের জোর দাবি, ডিএসসিসির দায়িত্বে যে খালগুলো রয়েছে আগে সেগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা হোক। তারপর তারা নতুন খাল নিয়ে কাজ শুরু করুক।’
এদিকে নতুন খালের সংখ্যা ৩০-৩২ বলা হলেও মূলত এক-দুইটি প্রবাহই বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নাম ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে খালের নাম নির্ধারণ বেশ জটিল বলে মন্তব্য করেছেন ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। তারা জানান, শ্যামপুর থেকে ডেমরা হয়ে শীতলক্ষ্যায় যে খাল পড়েছে এর নাম নিয়ে বেশ জটিলতায় পড়তে হয়। একই খাল শ্যামপুরে এক নাম আবার যাত্রাবাড়ীতে এসে হয়ে যাচ্ছে অন্য নাম। যাত্রাবাড়ী থেকে শনির আখড়ায় গিয়ে আবার সে খালের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুটা দূরে গিয়ে নতুন আরেকটি নামে সেই খালের প্রবাহ শুরু হয়েছে। এভাবে অনেক খাল রয়েছে যেগুলো ভিন্ন নামের হলেও মূলত একটাই খাল। আবার একাধিক খালও প্রবাহিত হয়েছে এক নামে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে দেখা গেছে, নতুন অন্তর্ভুক্ত খালের সংখ্যা অন্তত ৩০-এ দাঁড়াবে।
রাজধানীর খালগুলো একটি কর্তৃপক্ষের আওতায় আসার বিষয়টিকে অবশ্য ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী-ডেমরা অঞ্চলের কিছু খালের মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কিছু খালের মালিক ঢাকা জেলা প্রসাশক। যদি সব সিটি করপোরেশনের আওতায় আসে, তাহলে বিষয়টি খারাপ হবে না। সিটি করপোরেশন যখন বার্ষিক পরিকল্পনা করে তখন বিদ্যমান সব খাল নিয়ে পরিকল্পনা করলে সেটা আরো নাগরিকবান্ধব হয়ে উঠবে। তবে দায়িত্ব পাওয়ার পর খালগুলোর তত্ত্বাবধান যেন সঠিকভাবে হয় এটা নিশ্চিত করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব।’
ডিএসসিসির তথ্যমতে, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে জিরানী খাল, কালুনগর খাল, মাণ্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, পান্থপথ, সেগুনবাগিচা, কমলাপুর ও দোলাইরপাড় বক্স কালভার্টের দায়িত্ব পেয়েছে ডিএসসিসি। মাঝে মধ্যে এসব খালে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। এর বাইরেও শ্যামপুর খালের শাখা খাল কাজলা, তিতাস, কুতুবখালী উত্তর ও দক্ষিণ খাল, বরইতলা খালও পরিষ্কার করা হয়েছে কখনো-সখনো। একই সঙ্গে দোলাইরপাড়, ধোলাইখাল, বুড়িগঙ্গার শাখা নদী ও মাতুয়াইলেও পরিষ্কার কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। তবে দায়িত্ব পাওয়ার পরপর যেভাবে উদ্যোগ নিয়ে নেমেছিল সংস্থাটি, সে গতি আর দেখা যায়নি। দীর্ঘ এ সময়ে দখলে থাকা একটি খাল উদ্ধার তো দূরের কথা সীমানাই নির্ধারণ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ডিএসসিসির প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসেরের সঙ্গে বারবার তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।
খালের ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের চরম অবহেলার তীব্র সমালোচনা করেছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার যে দায়িত্ব নেয়ার তিন বছর হতে চলল, কিন্তু এখনো একটি খাল দখলমুক্ত কিংবা সীমানা নির্ধারণ করেনি কর্তৃপক্ষ। আগে দুই সিটির মালিকানায় ২৬টি খাল ছিল। এখন দক্ষিণে আরো ৩০টির মতো যুক্ত হবে। কিন্তু তাতে লাভ কী? এ খালগুলোও তো অব্যবস্থাপনায় পড়ে থাকবে। এখানে মশাবাহিত রোগসহ নানা ব্যাধির চাষ হবে। আসলে সিটি করপোরেশনের কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় যে যেভাবে পারছে করে যাচ্ছে। এ খালের পেছনে বিগত দিনে তারা কত হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে তা নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক। তখন জনগণই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সিটি করপোরেশন কতটুকু সফল হয়েছে বা কতটুকু ব্যর্থ।’