সদ্যসমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যদিও এ সময় সংস্থাটির আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকার কিছু বেশি। সে হিসেবে গত অর্থবছরে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা কম। যদিও এ সময় সংস্থাটির রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। ওই অর্থবছর ৩ লাখ ৮৫২ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর—প্রধানত এ তিন খাত থেকেই রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। গত অর্থবছরে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ছিল শুল্ক খাতে। ঘাটতির দিক থেকে পরের অবস্থানে ছিল যথাক্রমে ভ্যাট এবং আয়কর ও ভ্রমণ।
ডলার সংকটের কারণে গত অর্থবছরে পণ্য আমদানি ও এলসি খোলায় বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বিষয়টি শুল্ক খাতে রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, খাতটি থেকে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত অর্থবছরে আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে শুল্ক হিসেবে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল এনবিআর। যদিও সংস্থাটির আয় হয়েছে ৯২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। খাতটিতে রাজস্ব আহরণ ঘাটতি লক্ষ্যের তুলনায় ১৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
শুল্ক খাতে রাজস্ব আহরণ কমার কারণ হিসেবে আমদানি ও এলসি খোলায় কড়াকড়িকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরাও। চট্টগ্রাম চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানি-রফতানিতে ধীরগতি শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বেই হয়েছে। আমাদের এলসির ওপর একটা রেস্ট্রিকশন আছে। শতভাগ মার্জিনে এলসি খুলতে হচ্ছে। অনেকে খুলতেও পারছে না। আবার কাঁচামালও আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এসব কারণেই শুল্ক খাতে রাজস্ব আহরণ কমেছে।’
এনবিআরের বিভিন্ন শুল্ক দপ্তরের রাজস্ব আহরণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংস্থাটির এ-সংক্রান্ত ১৭ দপ্তরের ১১টিই রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে চট্টগ্রাম শুল্ক ভবন। ৭৪ হাজার ২০৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দপ্তরটি আহরণ করেছে ৬১ হাজার ৬৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে অর্থবছর শেষে ঘাটতি ১২ হাজার ৫৭৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা প্রায় ১৭ শতাংশ কম। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কম আদায় করেছে ঢাকার বন্ড কমিশনারেট। দপ্তরটির রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৫৯০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থবছর শেষে আহরণ করতে পেরেছে ৪ হাজার ৬২০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৩০ শতাংশ রাজস্বই আহরণে ব্যর্থ হয়েছে ঢাকার এ দপ্তর।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিগগিরই শুল্ক খাত থেকে রাজস্ব বাড়ার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৬ হাজার ৯৯৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময় ছিল ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার। সে অনুযায়ী গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে দেশে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশের বেশি।
ভ্যাট খাতে গত অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আহরণ হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। এ সময় খাতটি থেকে রাজস্ব আহরণ হয়েছে লক্ষ্যের তুলনায় ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। তবে এ সময় ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ভ্যাট খাত থেকে এনবিআরের রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। সে অনুযায়ী ভ্যাট খাতে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তথা মূল্যস্ফীতির কারণে ভ্যাট খাত থেকে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে এনবিআরের। যদিও মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য কারণে করপোরেট ব্যবসাগুলোকে গত অর্থবছরে বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। বিষয়টি এনবিআরের আয়কর ও ভ্রমণ কর খাত থেকে রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির প্রভাবেই মূসক থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে। আর ডলার সংকট ও ঋণপত্র খোলার ওপর কড়াকড়ির কারণে শুল্ক থেকে রাজস্ব আয় কমেছে। আয়কর থেকে সাধারণত রাজস্ব আয় খুব বেশি বাড়ে না আর করপোরেট ব্যবসাও এখন ভালো অবস্থায় নেই। অর্থনীতির অবস্থা ভালো না থাকায় করপোরেট ব্যবসায়ীদের লাভও কমেছে।’
২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে এনবিআরের আয়কর ও ভ্রমণ করে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকার বেশি। এ খাতে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আয় হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।
আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণের জন্য সারা দেশে এনবিআরের ৩১টি কর অঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো আয় করেছে ঢাকার কর অঞ্চল ৪ ও কর অঞ্চল ৯। এছাড়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছে চট্টগ্রামের কর অঞ্চল ৩ ও কর অঞ্চল ১। টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণ করেছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট। এছাড়া ভ্রমণ কর উপখাতে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৮ শতাংশ।
এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আয়কর, মুনাফা ও মূলধনি আয়কর থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া মূল্য সংযোজন করে থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা আহরণের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
সম্পূরক শুল্ক থেকে ৬০ হাজার ৭০৩ কোটি ও আমদানি শুল্ক বাবদ ৪৬ হাজার ১৫ কোটি টাকা আয়ের পরিকল্পনা রয়েছে।