কয়রায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র সংকটে সেবাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

খুলনার সর্বদক্ষিণের উপজেলা কয়রা। আড়াই লক্ষাধিক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য মূলত ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল।

খুলনার সর্বদক্ষিণের উপজেলা কয়রা। আড়াই লক্ষাধিক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য মূলত ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল। চাহিদা অনুপাতে এ অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের ছয়টিতেই নেই উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিও উপকূলীয় অঞ্চল থেকে বেশ দূরে। সময় ও খরচ সামলে উঠতে না পেরে অনেকে পল্লী চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। এমনিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অঞ্চলটির মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র না থাকায় সে ঝুঁকি আরো বেড়েছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

উপজেলার বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবন ঘেরা উপকূলবর্তী উপজেলাটির তিন দিকই নদীবেষ্টিত। জেলা শহর থেকে সড়কপথে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণের উপজেলাটিকে ঘিরে রেখেছে কপোতাক্ষ, কয়রা এবং শাকবাড়িয়া নদী। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নই সুন্দরবনের সীমানায় অবস্থিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলবায়ু পরিবর্তনে বিপর্যস্ত এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। খাদ্য, সুপেয় পানি, নিরাপদ বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র ছাড়াও তাদের অন্যতম সমস্যা স্বাস্থ্যসেবা।

উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম খান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলে লবণাক্ততাও বেড়েছে। এখানকার বাসিন্দারা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত। উপজেলার অধিকাংশ এলাকার রাস্তাঘাটও তেমন উন্নত নয়। ভ্যান পর্যন্ত চলাচল করে না। অনেক রাস্তায় হেঁটেও চলা দায়। যোগাযোগ প্রতিকূলতায় প্রাথমিক ও মধ্যম স্তরের স্বাস্থ্যসেবা এখনো তাদের কাছে সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। নিশ্চিত করা যায়নি নিরাপদ মাতৃত্ব।’

সালাম খান আরো বলেন, ‘উপজেলার আড়াই লক্ষাধিক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য মূলত ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল। তবে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার অন্যতম ভরসাস্থল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেটিও উপজেলা সদর থেকে আরো ১৫ কিলোমিটার দূরে। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে জেলা শহরে যেতে সময় লাগে ৫-৭ ঘণ্টা। এ কারণে সময় ও খরচ সামলে উঠতে না পেরে অনেকে পল্লী চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। প্রায়ই ভুল চিকিৎসার শিকার হন রোগীরা।’

ক্লাইমেট মুভমেন্ট বাংলাদেশ এবং কোস্টাললিডার্সের উপজেলা সমন্বয়ক শেখ সিরাজউদ্দৌলা লিংকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত নয়। সাতটি ইউনিয়নের ছয়টিতেই নেই উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও রয়েছে নানা সংকটে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত জনবল সংকট রয়েছে সেখানে।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে জরুরি অস্ত্রোপচার হয় না। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়মিত না পাওয়ায় নারীরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অতিরিক্ত টাকা খরচ করে তাদের বিভিন্ন ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করাতে হচ্ছে। উপজেলাটি প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় বসবাসের ঝুঁকি, সুপেয় পানি সংকটে চিকিৎসকরাও থাকতে চান না। যোগদানের পরই অন্যত্র বদলির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট কাটে না।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির দুটি ভবনের মূল ভবন ভেঙে ফেলায় এবং নির্মাণকাজ বিলম্ব হওয়ায় বিঘ্ন ঘটছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। কবে এ নির্মাণকাজ শেষ হবে তাও বলতে পারছেন না কেউ।

এ ব্যাপারে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চর্মরোগীর পাশাপাশি বছরজুড়ে এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন সুন্দরবন ও উপকূলবর্তী নারীরা। তাদের অধিকাংশের সমস্যা জরায়ু, ডিম্বনালী ও প্রজনন অঙ্গের। এসব রোগে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া এখানকার শিশু ও নারী অপুষ্টি এবং রক্তশূন্যতায়ও ভুগছেন।’

তবে ডা. রেজাউল করিমের দাবি, আগের তুলনায় উপকূলীয় সরকারি চিকিৎসাসেবার চিত্র অনেকটাই বদলেছে। সেবার মান ও হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিকের উন্নয়নও হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নারী-পুরুষের জন্য চালু করা হয়েছে এনসিডি কর্নার। নারীদের এএনসি-পিএনসি, ভায়া পরীক্ষাসহ শিশুদের আইএমসিআই সেবাও দেয়া হচ্ছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি মা ও শিশুদের পুষ্টি নিয়ে কাজ করছেন এনজিও কর্মীরাও। মানুষের মধ্যেও স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদান করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। এসব কারণে মাতৃ স্বাস্থ্যেসেবার মানও বেড়েছে। পাশাপাশি কমেছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার। সরকারি চিকিৎসাসেবায় কিছুটা হলেও আস্থা ফিরেছে উপকূলীয় মানুষের।

ডা. রেজাউল করিম বলেন, ‘চিকিৎসক ও অবকাঠামো সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে এবং প্রযুক্তিনির্ভর আরো কিছু আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা গেলে উপকূলীয় মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় অনেক পরিবর্তন হবে। জনগণ সহজে সেবা পাবে, স্বাস্থ্যসেবা হয়ে উঠবে রোগীবান্ধব।’

সার্বিক বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন শফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিছু চিকিৎসক বাড়ানো হয়েছে। ওখানে নিয়মিত গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতির পাশাপাশি আরো জনবল নিয়োগের চেষ্টাও চলছে।’

আরও