দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চল চুনতি। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী ছাড়াও কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় এ বনের ব্যাপ্তি। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৮৬ সালে বনাঞ্চলটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। তবে বনটির আয়তন ও জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। দখল-দূষণ, বন উজাড় ছাড়াও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বিদেশী গাছের আধিক্যে ভেঙে পড়ছে বনের ইকো-সিস্টেম। দেশীয় গাছের উপস্থিতি বাড়িয়েও কাঠ পাচারকারীদের কবল থেকে রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে বন বিভাগ।
বন থেকে নিয়মিত মধু সংগ্রহ করেন মৌয়াল এসএম চৌধুরী। স্থানীয়দের কাছে তিনি সিকো ভাই নামেও পরিচিত। তার বাড়ি চুনতি সংরক্ষিত বনঘেঁষে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, সংরক্ষিত বনে এখন মৌমাছির সংখ্যা একেবারেই কমে এসেছে। মধু না পেয়ে মৌয়ালদের অনেকেই ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছেন।
২০১০ সালের পর সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির একটি প্রকল্পের আওতায় বনে বিপুল পরিমাণ আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস-জাতীয় বৃক্ষ রোপণ করা হয়। দ্রুত রিটার্ন পাওয়ার আশায় অংশগ্রহণকারীরা বিদেশী গাছ রোপণ করায় দেশীয় প্রজাতির গাছের পরিমাণ ক্রমাগত কমতে থাকে। এতে বনের মৌমাছি, বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুসহ দেশীয় গাছের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সংরক্ষিত বন ও বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যের ওপর দিয়ে রেলপথ নির্মাণ, সড়কে যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি, সড়ক সম্প্রসারণের প্রয়োজনে বনের জমি ব্যবহার, অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক ছড়া, খাল ও ঝিরি থেকে অবাধে বালি উত্তোলন, অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বনের মাটি ব্যবহারসহ অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে সংরক্ষিত বনের প্রাণ-প্রকৃতি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে।
মধু না পাওয়ার কারণ হিসেবে এসএম চৌধুরী মনে করেন, বনে আগে যেসব দেশীয় গাছ ছিল সেগুলো ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে। অনেক দেশীয় গাছের অস্তিত্ব এখন আর দেখা যায় না। মৌমাছি ফুল থেকে দুটি জিনিস সংগ্রহ করে। একটা রস, অন্যটা রেণু। তবে বর্তমান অবস্থা হয়ে গেছে; মৌমাছি এক ফুল থেকে রেণু পেলেও রস সংগ্রহের জন্য অন্য ফুল পাচ্ছে না। যেসব গাছ থেকে তারা উভয় উপাদান সংগ্রহ করত ওই গাছগুলো এখন আর আগের মতো নেই। এপ্রিলের শুরু থেকে জুনের প্রথম এক-দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ‘হানি সিজন’ বলা হয়। এ সময় মৌমাছি মৌচাক তৈরি করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হানি সিজনে মৌচাকের সন্ধান পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে বলে হতাশা ব্যক্ত করেন অভিজ্ঞ এ মৌয়াল।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চুনতি সংরক্ষিত বনে আম, জাম, কাঁঠাল, গর্জন, নিম, কেরল, শিশু, বট, হিজল, গোয়াইসসা লতাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। কিন্তু এখন এসব গাছের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে বনের গাছ সংকট দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে সংকট আরো প্রকট হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, লোহাগাড়া অংশের ২৮ হাজার ৩২১ একর ভূমি সংরক্ষিত বন ছিল। ১৯৮৬ সালের ১৮ মার্চ ১৯ হাজার ১৮৫ দশমিক ১৯ একর বন চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ থেকে সরিয়ে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। বাকি ৯ হাজার ১৩৫ দশমিক ৬৪ একর জমি এখনো সংরক্ষিত বন হিসেবে রয়েছে। ২০১২-১৩ সালের দিকে প্রকল্পের অধীনে ব্যক্তি উদ্যোগে এ বনে সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে বৃক্ষ রোপণ শুরু হয়। কিন্তু দ্রুত অধিক লাভের জন্য বেসরকারি সুবিধাভোগীরা বিদেশী গাছ রোপণ শুরু করলে বনের প্রকৃতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। এতে বনটির জীববৈচিত্র্য দ্রুত বদলাতে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বন বিভাগ সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি বাদ দিয়ে নিজেরা দেশীয় প্রজাতির গাছ রোপণ শুরু করেছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চুনতি সংরক্ষিত বনে ২০১০ সালের পর সামাজিক বনায়ন করা হয়েছিল। তখন সুবিধাভোগীরা দ্রুত লাভের আশায় বিদেশী গাছ লাগিয়েছিলেন। বর্তমানে আমরা সেই কর্মসূচি বাদ দিয়ে নিজেরাই বনায়ন করছি। বিগত কয়েক বছরে চুনতি সংরক্ষিত বনে প্রায় ৬০০ একরে দেশীয় প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখলে বনে আগের রূপ ফিরে আসবে।’
সরজমিনে চুনতি সংরক্ষিত বনে গিয়ে দেখা গেছে, বন উজাড় ও অবাধে গাছ নিধনের ফলে বনটির ইকো-সিস্টেম কার্যত ভেঙে পড়েছে। সংরক্ষিত বন ও অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ হওয়ায় বিপুল পরিমাণ গাছ নিধন করা হয়েছে। বনের ভেতর দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক থাকায় এমনিতে বন্য প্রাণীর চলাচল ব্যাহত হচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় প্রায়ই সড়ক পারাপারে বনের প্রাণী মারা যাচ্ছে। দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বনের অনেক স্থানেই সড়ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এতেও বনের গাছ নিধনের হার বেড়েছে।
বন অধিদপ্তরের সংরক্ষিত বন ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সড়কপথের পাশাপাশি রেললাইনের জন্য এরই মধ্যে ২৭ কিলোমিটার বনের একটি বড় অংশ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এতে গাছ নিধনসহ সংরক্ষিত ও অভয়ারণ্যে হাতি ও বিভিন্ন প্রাণীর বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সড়ক বিভাগ মহাসড়কটি ছয় লেন করতে দ্বিতীয় দফায় সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। বন বিভাগের কাছে অনুমোদন চাইলেও তারা দিতে রাজি নয়। তবে শর্ত সাপেক্ষে উড়ালপথ নির্মাণের পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছে বন অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বন্য এশীয় হাতির যাতায়াতের একটি করিডোর হিসেবে চুনতি সংরক্ষিত বন ও চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ব্যাপ্তি। এ দুই সংরক্ষিত বনের বিশালকায় শতবর্ষী মান্দার, গর্জন গাছ দেশব্যাপী সুপরিচিত। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ চুনতি সংরক্ষিত বনের অনন্য গুরুত্ব হচ্ছে এশিয়ান হাতির আবাস ও চলাচলের পথ। এ বনে ১ হাজার ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়, যার মধ্যে ৪৫ প্রজাতির উঁচু গাছও রয়েছে। এছাড়া আগে ১৭৮ প্রজাতির জীবজন্তু ও পাখি পাওয়া যেত, যার মধ্যে রয়েছে ছয় প্রজাতির উভচর, আট প্রজাতির সরীসৃপ ও ১৩৭ প্রজাতির পাখি। এছাড়া সংরক্ষিত বনে ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস ছিল।
বন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের তথ্য বলছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, নির্বিচারে গাছ কাটা, সংরক্ষিত বনের মধ্যে রেলপথ নির্মাণ, বনের ভূমি বেদখল করে বসতি স্থাপন, বনের পাহাড় কেটে কৃষিজমিতে রূপান্তরের ফলে দেশের অন্যতম সংরক্ষিত বনাঞ্চলটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে বন্যপ্রাণী ও পশু-পাখির একটি বড় অংশ কমে যাওয়া বা অন্যত্র চলে যাওয়ার হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু প্রজাতি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে। জীবজন্তুর মধ্যে দুই প্রজাতির উভচর, দুই প্রজাতির সরীসৃপ, দুই প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও প্রায় ১১ প্রজাতির পাখি বর্তমানে বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
এসব বিষয়ে কথা হয় চুনতি ফরেস্ট রেঞ্জের কর্মকর্তা গাজী বাহার উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকজন মানুষ এসে বনের সার্বিক অবস্থা দেখে গেছেন। এখন পরিবেশের জন্য যেসব গাছ ক্ষতিকর তা কেটে মাটি ও পরিবেশ উপযোগী গাছ লাগানোর পরিকল্পনা চলছে। দেশীয় গাছ যেমন—হিজল, ডুমুর, নারকেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বনের সার্বিক বিষয়ে আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে চুনতি সংরক্ষিত বন আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
বন বিভাগের তথ্য বলছে, চুনতি সংরক্ষিত বনের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে প্রভাবশালীরা বন দখল করছে। এরই মধ্যে বনের তিন হাজার একর জমি প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে প্রশাসনের সহায়তায় বন দখলসহ বালি উত্তোলন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৬ জানুয়ারি বন বিভাগের আপত্তির পর বনের ভেতরে বালি উত্তোলন বন্ধ করে দেয় লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসন। তবে ২০২৪ সালে বনের সাতগড় ছড়া থেকে ১৫ হাজার ঘনফুট বালি নিলামের কার্যাদেশ দেয় প্রশাসন। এভাবে বনের প্রাকৃতিক খাল, ঝিরি ও ছড়া থেকে বালি উত্তোলনের মাধ্যমেও বনটিকে নিষ্প্রাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রেঞ্জ কর্মকর্তাদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দখল করা জমি উদ্ধারে এরই মধ্যে ২ হাজার ১০০টি উচ্ছেদ মামলা করেছে বন বিভাগ। আগে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক সময় মামলাগুলোর কার্যক্রম গতিশীল ছিল না। বর্তমানে মামলার মাধ্যমে উচ্ছেদ ও বেদখল তৎপরতা বেড়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সংরক্ষিত বনের দখল হওয়া ভূমি উদ্ধারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
২০১৯ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জোন থেকে দুই ভাগে ২০৭ দশমিক ১৪ একর (চট্টগ্রামের ৪২ ও কক্সবাজারের ১৬৫ একর) সংরক্ষিত বনের জমি রেলওয়েকে দেয়া হয়। বনটি সংরক্ষিত বনের তালিকা থেকে রহিত করা হয় একাধিক শর্ত যুক্ত করে। কিন্তু রেলওয়ের পক্ষ থেকে শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থতায় বনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
চুনতি সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্র্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি সংগঠন ‘চুনতি রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়ক সানজিদা রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দখলদারদের দৌরাত্ম্য, বিদেশী গাছ রোপণের মাধ্যমে পশু-পাখির আবাস নষ্ট করাসহ বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে বনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ ওই অঞ্চলে বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এমনিতে রেলপথ নির্মাণের ফলে বনের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। এখনই উদ্যোগ নেয়া না হলে পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসার শঙ্কা রয়েছে।’