সুন্দরবনে ফেরানো যাবে কি বাটাগুর কাছিমের বিচরণ

বাংলাদেশে প্রায় ৩০ প্রজাতির কাছিম বা কচ্ছপ রয়েছে। তার মধ্যে ‘বাটাগুর বাসকা’ বা নর্দান রিভার টেরাপিন অতি বিপন্ন প্রজাতির কাছিম। এককালে সুন্দরবন এলাকায় প্রচুর দেখা যেত কাছিমটি। যদিও দুই দশক আগে এ প্রজাতির কাছিমটিকে বিপন্ন বলেই ধরা নেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর দেখা পাওয়া যেত। কাছিমটি টিকিয়ে রাখতে বন বিভাগসহ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে এক

বাংলাদেশে প্রায় ৩০ প্রজাতির কাছিম বা কচ্ছপ রয়েছে। তার মধ্যে ‘বাটাগুর বাসকা’ বা নর্দান রিভার টেরাপিন অতি বিপন্ন প্রজাতির কাছিম। এককালে সুন্দরবন এলাকায় প্রচুর দেখা যেত কাছিমটি। যদিও দুই দশক আগে এ প্রজাতির কাছিমটিকে বিপন্ন বলেই ধরা নেয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর দেখা পাওয়া যেত। কাছিমটি টিকিয়ে রাখতে বন বিভাগসহ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে এক যুগের বেশি সময় ধরে। আবার সুন্দরবনে বাটাগুর কাছিমের স্বাভাবিক বিচরণ ফেরানো সম্ভব বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।

বাটাগুর কাছিমের স্থানীয় নাম কেটো কাছিম, কাইট্টা কাছিম বা বোদো কাছিম। এরা মিঠা ও নোনা—দুই ধরনের পানিতেই বাস করতে পারে। কাছিমের আর কোনো প্রজাতির এমন সক্ষমতা নেই। স্বভাবগত কারণে অনেকে এটিকে নদীমাতৃক কাছিমও বলে থাকেন। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করা সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে বাটাগুর কাছিমের নাম। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতি সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এটি শিকার, মাংস বা অংশবিশেষ অথবা এর থেকে উৎপন্ন দ্রব্য দান, বিক্রি বা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

প্রকৃতিতে বাটাগুর কাছিমের বিচরণ খুবই সীমিত। এমনকি গবেষকদের নজরেও দীর্ঘ সময় কাছিমটির উপস্থিতি ছিল না। গবেষকরা ২০০০ সালের দিকে ধরেই নিয়েছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কাছিম একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পরে ২০০৮ সালে গবেষকরা বাটাগুর বাসকা আছে কিনা, তা খুঁজতে শুরু করেন। এরপর তারা নোয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন জলাশয়ে আটটি বাটাগুর বাসকার সন্ধান পান। এর মধ্যে চারটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী। প্রজননের জন্য গাজীপুরে নিয়ে যাওয়া হয় কাছিমগুলোকে।

একসময় সুন্দরবন থেকে শুরু করে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া উপকূল পর্যন্ত বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কাছিমের বসতি ছিল। তবে কিছু মানুষের খাবার হিসেবে এই কাছিমের দিকে দৃষ্টি এবং প্রকৃতির বিরূপতায় এটি বিলুপ্ত হতে বসেছিল। বিলুপ্তপ্রায় বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কাছিম সংরক্ষণ ও প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১২ সালে। এ লক্ষ্যে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন এলাকায় ২০১৪ সালে গড়ে তোলা হয় বাটাগুর বাসকা কাছিম প্রজনন কেন্দ্র। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা জুটি এসএ আমেরিকা ও বাংলাদেশ বন বিভাগ। এ কেন্দ্র থেকে কাছিমের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার পর সেগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হলে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরে অবমুক্ত করাই এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। আর এ গবেষণার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় এ কাছিম প্রজাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলেও আশাবাদী ছিলেন তারা।

গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানান, এর ফলে জানা যাবে এ প্রজাতির কাছিমের স্বভাব, খাদ্য সংগ্রহ, বিচরণ, পরিবেশসহ বঙ্গোপসাগরের গভীর ও অগভীর পানিতে থাকতে পছন্দ করে কিনা সেসব বিষয়ে। এছাড়া এ কাছিম বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশ ছেড়ে ভারত ও শ্রীলংকাসহ অন্য দেশের সমুদ্রসীমায় যায় কিনা জানা যাবে তাও।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা আশাবাদী বাটাগুর বাসকার বিচরণ আবার স্বাভাবিক করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পাচার হওয়া ও জেলেদের হাতে নিধন হওয়ার চ্যালেঞ্জই বড়। এ দুটো যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মোকাবেলা করতে পারে তাহলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।’

২০১৪ সালে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন ও লালন-পালন কেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় বাটাগুর বাসকা প্রকল্প চালু করার পর ২০১৭ সালে দুটি কাছিম যথাক্রমে ৩১টি ও ৩২টি ডিম দেয়। তা থেকে ২৮ ও ২৯টি বাচ্চা পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে দুটি কাছিম যথাক্রমে ২৬টি ও ২০টি ডিম দেয়। তা থেকে যথাক্রমে পাঁচটি ও ১৬টি বাচ্চা পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে একটি কাছিমের ৩২টি ডিম থেকে ৩২টি বাচ্চাই পাওয়া যায়।

সার্বিক বিষয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকল্পের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে কাছিমটির এ প্রজাতি যেন টিকে থাকে। তবে আগের মতো বিচরণ বা স্বাভাবিক বিচরণ ফিরে আসবে এটা বোধ হয় হবে না। কারণ আগের মতো কি এখন কিছু আছে? সুন্দরবনে পরিবর্তন এসেছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। তাই আগের মতো না হলেও প্রজাতিটি যেন হারিয়ে না যায়, সে চেষ্টাই করা হচ্ছে।’

আরও