দক্ষিণ এশিয়ার অপ্রাতিষ্ঠানিক বৈদেশিক লেনদেন আবর্তিত হচ্ছে মূলত হুন্ডি ও হাওলা ব্যবস্থাকে ঘিরে। বিশ্বব্যাংকের দুই বিশেষজ্ঞের এক হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় পর্যায়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রাতিষ্ঠানিকের অর্ধেক। তবে সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণগুলোয় দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার বৈদেশিক লেনদেনে অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাগুলো এখন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর গৃহীত নানা পদক্ষেপকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য হলো এসব পদক্ষেপ বহুলাংশেই উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের দিক থেকেও কখনো কখনো তা বুমেরাং হয়েছে।
বর্তমানে এ অঞ্চলের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের বড় একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে হুন্ডি ও হাওলা। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদের দপ্তরের সিনিয়র ইকোনমিস্ট জোয়ে লিউ শি এবং কনসালট্যান্ট শিয়াও ইউ ঝুয়ের এক সাম্প্রতিক যৌথ পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, এখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে। এতে হুন্ডি-হাওলার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। একই সঙ্গে চাপ পড়ছে রিজার্ভেও। আমদানির বিল পরিশোধ এবং আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ছে দেশগুলো।
বিশ্বব্যাংকের এ দুই বিশেষজ্ঞের মতে, অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে হুন্ডি ও হাওলার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্কগুলোর অবদান বাড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী শ্রমিকদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিংয়ের পদ্ধতিকে এখনো সহজ করে তোলা যায়নি। এজন্য তাদের বড় একটি অংশ এখন হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক ও সহজ পদ্ধতিকে বেছে নিচ্ছেন। এভাবে পদ্ধতিগুলো এখন সনাতনী সমাজের অংশ হয়ে উঠছে। অন্যদিকে রিজার্ভে শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ যুক্ত হচ্ছে না রেমিট্যান্স হিসেবে।
২০১৭ সালে ভারতের মুদ্রা প্রত্যাহারের ঘোষণা সেখানকার হুন্ডি ব্যবসায়ীদের জন্য বড় ধরনের আঘাত হয়ে এসেছিল। তবে দেশটিতে এখন আবার হুন্ডির ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ও ভারতে হুন্ডি ও হাওলাকে অনেকটা একই অর্থে দেখা হলেও ভারতে হাওয়ালার প্রায়োগিক অর্থ ভিন্ন। দেশটিতে হাওলা শব্দটির ব্যবহার হয় মূলত পুরনো বিল অব এক্সচেঞ্জ ভাঙানো অর্থে। সম্প্রতি হুন্ডি ইস্যুতে ভারতের সবচেয়ে ধনী ধর্মীয় ট্রাস্ট তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানমকে (টিটিডি) ৩ কোটি রুপি জরিমানা করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ভক্তদের দেয়া বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তে হুন্ডির অর্থ জমা রাখা নিয়ে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এ জরিমানা করা হয়।
মূলধনপ্রবাহে নিয়ন্ত্রণ আরোপও অনেক সময় অর্থনীতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক বৈদেশিক লেনদেনের কারণ হয়ে দেখা দেয়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ট্রেড কস্ট ডাটাবেজের হিসাব অনুযায়ী, আন্তঃদেশীয় লেনদেনে অশুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) প্রভাব কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুল্কবাধার (ট্যারিফ ব্যারিয়ার) ২১৪ শতাংশও হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসায়ীর পক্ষেই মূলধনের অভাবে এ ধরনের বাধার ধাক্কা সামলানো কঠিন। এ অবস্থায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ক্ষুদ্র আমদানিকারক হুন্ডি এজেন্টদের দ্বারস্থ হচ্ছেন বলে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এসব এজেন্ট প্রায়ই সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র আমদানিকারকদের স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবেও কাজ করছেন, ব্যাংক থেকে এভাবে প্রয়োজনমতো স্বল্পমেয়াদি কার্যকর মূলধনের সংস্থান করা এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পক্ষে অনেক কঠিন। আবার শুল্ক-অশুল্ক অনেক বাধা অনেক সময় পাচারের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যেরও কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ অপ্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্য হুন্ডি ও হাওয়ালার মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের চাহিদাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।
কৃত্রিমভাবে মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে গিয়েও বিপত্তিতে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশে গত এক দশক ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে তৎপর ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৯ টাকা ১০ পয়সা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ডলারের এ দর ধরে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে টাকার মান কিছুটা অবনমন করা হলেও সেটির হার ছিল খুবই কম। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষেও প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটের কারণে এরপর টাকার শক্তিশালী অবস্থান আর ধরে রাখা যায়নি।
গত দেড় বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৭ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষেও প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। বর্তমানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেই প্রতি ডলার ১০৯ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে টাকার এত বড় অবমূল্যায়ন এর আগে দেখা যায়নি।
দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতিবিদরা টাকার শক্তিশালী মান ধরে রাখার সমালোচনা করে আসছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের ভাষ্য ছিল—ডলারের বিপরীতে টাকার যে মান দেখানো হচ্ছিল সেটি কৃত্রিম। অর্থনীতিকে শক্তিশালী দেখানোর পাশাপাশি আমদানিকারকদের সুবিধা দিতে টাকার মান বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল, ধীরে ধীরে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে অবমূল্যায়ন করা। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে সেটি করা হয়নি। দেশে হুন্ডির বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতির দায় সবচেয়ে বেশি।
অর্থনীতিবিদদের অভিযোগের সত্যতা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও। বৃহৎ অর্থনীতির ১৫টি দেশের মুদ্রাঝুড়ি তৈরি করে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বা রিয়াল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (রিয়ার) নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্লেষণে ২০১৯ সালের আগস্টে ডলারের প্রকৃত বিনিময় হার ছিল ৯১ টাকা ২১ পয়সা। কিন্তু ওই সময় দেশের আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
শুধু দৈনন্দিন ভিত্তিতেই নয়, বরং ১০ ও ১৫টি দেশের কারেন্সি বাস্কেট তৈরি করে বার্ষিক ভিত্তিতে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০টি দেশের কারেন্সি বাস্কেটের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার নির্ধারণ করে ১৪৯ টাকা ৯৯ পয়সা। ১৫টি দেশের মুদ্রাঝুড়ি বিশ্লেষণ করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে প্রতি ডলার ৮০ থেকে ৮২ টাকার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদনেও প্রায় একই ধরনের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল। সংস্থাটির ভাষ্য ছিল, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮০ টাকা ৬০ পয়সা। কিন্তু ওই সময় ডলারের নমিনাল ইফেক্টিভ রেট (নিয়ার) ছিল ১০১ টাকা। একই সময়ে ডলারের প্রকৃত মূল্য বা রিয়াল ইফেক্টিভ রেট (রিয়ার) ছিল ১৩৯ টাকা। ডলারের বিনিময় মূল্যের সঙ্গে নমিনাল ও রিয়াল ইফেক্টিভ রেটের বিশাল এ ব্যবধানকে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে অভিমত দিয়েছিল সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য হলো, ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে গত এক দশকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভুল নীতিতে চলছে। এ ভুল নীতির খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।
বণিক বার্তাকে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘গত এক দশকে ডলারের বিনিময় হারকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা গায়ের জোরে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিল। এ কারণে দেশের রফতানি খাত ও রেমিট্যান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপরীতে চাঙ্গা হয়েছে হুন্ডিসহ অননুমোদিত লেনদেন।’
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব ছিল ভোগ্যপণ্যের বাজারের তেল-চিনি কিংবা পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করা। সরকার সেটি না করে বিনিময় হার ও সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে গেছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোঝার দরকার ছিল, বিনিময় হার ও সুদের হার নিয়ন্ত্রণের বিষয় নয়। রিজার্ভের অস্বাভাবিক ক্ষয় ও বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির ফল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত এক বছরে রিজার্ভ থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এভাবে বানের জলের মতো ডলার বিক্রি করে বাজার স্বাভাবিক করা যাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে যৌক্তিক বৈধ লেনদেনও এখন অবৈধ চ্যানেলের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে এখন ব্যাংকগুলোতে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা যাচ্ছে না। বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হলে শিক্ষার্থীদের এখন কার্ব মার্কেট থেকে ডলার কিনে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে হচ্ছে। ভ্রমণ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত অনেক বৈদেশিক লেনদেনও এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, একটি যৌক্তিক বৈধ প্রক্রিয়ার লেনদেনও অবৈধ চ্যানেলে চলে যাচ্ছে। তার মানে, ডলারের লেনদেন কিন্তু থেমে নেই। আমি নিজে মাত্র ৫ ডলার পরিশোধ করতে গিয়েও পারিনি। শেষ পর্যন্ত অন্য একজনকে বলে নগদে পরিশোধ করতে হয়েছে। বৈদেশিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ডলারের দরও বেঁধে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে হুন্ডিসহ অন্যান্য অবৈধ লেনদেন প্রক্রিয়াই উৎসাহিত হচ্ছে।’
ড. জাহিদ হোসেন জানান, বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ হলো বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বাজার (ফরমাল মার্কেট) আর অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারের (ইনফরমাল মার্কেট) মধ্যে ডলারের বিনিময় হার যদি ১ শতাংশ বাড়ে, তাহলে ফরমাল মার্কেট থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা ইনফরমাল মার্কেটে চলে যায়। যেসব অর্থনীতিতে মূলধন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, সেখানে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সত্ত্বেও অর্থ বের হয়ে যায়। আর কোনো দেশ থেকে অবৈধ পথে অর্থ বের হয়ে যাওয়ার পথই হলো হুন্ডি। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে হুন্ডির তৎপরতা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।