দেশের বিভিন্ন খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর। বিশেষ করে গ্যাস ও জ্বালানি এবং আর্থিক খাতে মার্কিন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। তবে বড় অংকের এ বিনিয়োগের বিপরীতে ডলারে পাওনা অর্থ আদায় করা নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী মার্কিন কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে পেট্রোবাংলার কাছে বড় অংকের পাওনা আটকে রয়েছে জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান শেভরনের। প্রতিষ্ঠানটিসহ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলোর পাওনা আদায়ে এবার তৎপর হয়েছেন বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বিষয়টি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, খোদ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
দেশে পুঞ্জীভূত প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই স্টক) উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এ বছরের মার্চ শেষে দেশে মোট এফডিআই স্টকের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যার পরিমাণ ৪০৫ কোটি ১২ লাখ ডলার। গ্যাস ও জ্বালানি খাতে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিআই স্টক সবচেয়ে বেশি, যার পরিমাণ ২৮৭ কোটি ১৮ লাখ ডলার। এছাড়া বীমা খাতে ২৬ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ২৩ কোটি ৭৬ লাখ, ব্যাংক খাতে ২০ কোটি ২৮ লাখ, বিদ্যুৎ খাতে ১৬ কোটি ১৬ লাখ, বস্ত্র খাতে ১২ কোটি ৭১ লাখ, ট্রেডিংয়ে ৭ কোটি ৮৩ লাখ, কেমিক্যাল ও ওষুধ খাতে ৯১ লাখ, টেলিযোগাযোগ খাতে ৫৭ লাখ, কৃষি ও মৎস্য খাতে ৩১ লাখ, খাদ্য খাতে ২২ লাখ, নির্মাণ খাতে ১৮ লাখ ও অন্যান্য খাতে ৭ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের এফডিআই স্টক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি জ্বালানি খাতের জায়ান্ট শেভরনের। উত্তোলনকৃত গ্যাস বিক্রির বিল হিসেবে পেট্রোবাংলার কাছে বিপুল অর্থ আটকে রয়েছে কোম্পানিটির। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্যাস বিক্রির বিল বাবদ বহুজাতিক কোম্পানিটি কম-বেশি ২৩ কোটি ডলারের মতো অর্থ পাবে পেট্রোবাংলার কাছে। এ অর্থ পরিশোধের জন্য কোম্পানিটি কয়েক দফা চিঠি দিলেও কোনো সুরাহা মেলেনি।
বকেয়া বিলের পাশাপাশি মার্কিন কোম্পানি শেভরনের বড় অংকের মুনাফার অর্থও আটকে আছে। কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশের অর্থও পাঠাতে পারছে না। এছাড়া বীমা খাতের কোম্পানি মেটলাইফের ক্ষেত্রেও লভ্যাংশের অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে ২০১৯ সালের লভ্যাংশের অর্থ পাঠিয়েছে মেটলাইফ। এছাড়া আরো বেশকিছু মার্কিন কোম্পানিও এ ধরনের সমস্যায় পড়েছে।
বাংলাদেশে ব্যবসা করা মার্কিন কোম্পানিগুলোর আটকে থাকা বকেয়া অর্থ পরিশোধসহ লভ্যাংশের অর্থ প্রত্যাবাসন এবং কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এখন দিনে দিনে আরো সরব হয়ে উঠছে মার্কিন দূতাবাস। কোম্পানিগুলোর বকেয়া অর্থ দ্রুত পরিশোধ করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কাছে দূতাবাসের পক্ষে লিখিত ও মৌখিক অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর পরও বকেয়া পরিশোধ নিয়ে জ্বালানি বিভাগ বা পেট্রোবাংলার দিক থেকে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু বুঝি, ডলারভিত্তিক লেনদেনে বাংলাদেশের বাইরে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অনুমোদনের কাজটি করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুতরাং এ বিষয়ে জানতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করাই ভালো।’
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর পাওনা আটকে থাকার বিষয়টি সম্প্রতি দেশের এক গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি জানান, ডলার সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কোম্পানির অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে না। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এর ফলে গত ১৫ বছর বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য ভালো স্থান হিসেবে যে সুনাম অর্জন করেছিল তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর পাওনা অপরিশোধিত থাকার বিষয়টি যত দীর্ঘায়িত হবে, নতুন করে এখানে বিনিয়োগে তাদের আগ্রহও তত কমবে। এর সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন অন্যান্য কোম্পানিরও বাংলাদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
সম্প্রতি আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) এক সভায় ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের ফরেন কমার্শিয়াল সার্ভিসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর জন ফে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিল্প খাত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদেশী বিনিয়োগকারী। বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের অনেক আগ্রহ সত্ত্বেও এখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য বিদেশী সংস্থাগুলোর অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পেমেন্ট সমস্যা, আয় ও মুনাফা বাবদ অর্থ ফেরতের সামর্থ্য, নীতি প্রণয়নের অস্বচ্ছতা এবং মেধা সম্পদ অধিকারের অপর্যাপ্ত প্রয়োগ। বাংলাদেশে লজিস্টিক এবং পরিবহন অবকাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে, যা বাণিজ্যকে বাধা দেয় ও শ্লথ করে দেয়। এ সমস্যাগুলো বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা অর্জনের পূর্ণ সক্ষমতাকে সীমিত করে এবং বিদেশী বিনিয়োগের জন্য হতাশা সৃষ্টি করে।’
মার্কিন কোম্পানিগুলোর এসব সমস্যার সুরাহা না হলে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের যারা ম্যানুফ্যাকচারার আছে তারা এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না। যারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি করেন, তারা ডলার পাচ্ছেন না। যারা লভ্যাংশ পাঠাতে চাইছেন, তারা ডলার সংক্রান্ত সমস্যায় পড়েছেন। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বেশি, আমদানি কম। আমাদের দেশের আমদানিকারকরা এলসি খুলতে না পারলে পণ্য আসবে কীভাবে। এসব বিষয়ই এখন ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলছে।’
বকেয়া পাওনা পরিশোধের বিষয়ে শেভরন ও পেট্রোবাংলার মধ্যে কয়েক দফা চিঠি চালাচালির পাশাপাশি বৈঠকও হয়েছে। গত ১৩ জুলাই পেট্রোবাংলার কাছে একটি চিঠি দেয় শেভরন। শেভরনের ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত শেভরন কর্তৃক সরবরাহকৃত গ্যাস ও কনডেনসেটের বিপরীতে কোম্পানির দাখিলকৃত ইনভয়েস অপরিশোধিত, আংশিক পরিশোধিত ও বিলম্বে পরিশোধের কারণে সুদসহ শেভরনের অনুকূলে বর্তমানে অপরিশোধিত মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮ কোটি ৭ লাখ ২৬ হাজার ডলার।
শেভরনের বকেয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া ও কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বণিক বার্তা বলেন, ‘শেভরন ২৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে অনুসৃত নীতি অনুসারে ব্যবসায়িক ইস্যু নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করি না।’
মার্কিন কোম্পানিগুলোর, বিশেষ করে শেভরনের বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য ডলার ও আর্থিক সংকট নিরসনে মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চেয়েছে পেট্রোবাংলা। গত জুলাইয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে পেট্রোবাংলা জানায়, ডলার ও আর্থিক সংকটের কারণে শেভরনের বকেয়া বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিতে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বকেয়া পরিশোধ নিয়ে পেট্রোবাংলার সমস্যা অনেকটাই কমে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার ছাড় করা হচ্ছে, যেটি আগে বিলম্ব হতো। বর্তমানে সরবরাহকারীদের ১৮ কার্যদিবসের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। মূলত গ্যাস বিক্রি বাবদ পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ বকেয়া পড়ে থাকায় বড় একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। এগুলো ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। এক জায়গায় সমস্যা হলে বাকিগুলোয়ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। শেভরনের রেগুলার পেমেন্ট আমরা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে আমাদের দফায় দফায় মিটিং হয়েছে। তারাও এখন বিষয়টি উপলব্ধি করেছে। ফলে পাওনা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিদেশী তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আমাদের খুব বেশি সমস্যা এখন নেই।’
ডলার সংকটের কারণে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোই নয়, দেশে ব্যবসারত অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিও লভ্যাংশ প্রত্যাবাসন, রয়্যালটি ফি পরিশোধ ও বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে। এরই মধ্যে বেশকিছু তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি ডলার সংকটের কারণে বিদেশে অর্থ পাঠাতে পারছে না। ডলার সংকটের কারণে লভ্যাংশের অর্থ পাঠাতে না পেরে এ অর্থ চলতি মূলধন হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদনও নিয়েছে মুম্বাইভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রা তারল্যের বর্তমান নিবিড়তার কারণে এফআইসিসিআই সদস্যরা মুনাফা প্রত্যাবর্তন ও কিছু প্রাপ্তির বিলম্বের কথা জানিয়েছেন। তবে বিশ্ব নজিরবিহীন হেডওয়াইন্ডের মুখোমুখি হয়েছে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ বছরের সাম্প্রতিক মাসগুলোয় চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত হয়েছে তা বিবেচনায় ব্যাংকগুলো গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি অর্থ প্রদানে সক্ষম হচ্ছে। তবে নতুন পেমেন্ট জমা হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা তিন থেকে ছয় মাস সময় নিতে পারে। অন্তর্বর্তী সময়ে, সব স্টেকহোল্ডারকে সহযোগিতা করতে হবে এবং বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এড়াতে হবে।’