গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি

সিলেট অঞ্চল ঘিরেই খনন ওয়ার্কওভারে জোর

দেশে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে সম্ভাব্য মজুদ অঞ্চলগুলোয় জরিপ ও খনন কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে সাগর এলাকায় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানোর কথা। এর সঙ্গে সঙ্গে খনন কার্যক্রম চালানোর মাধ্যমে বিদ্যমান কূপগুলো থেকেও উত্তোলন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যাতে

দেশে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে সম্ভাব্য মজুদ অঞ্চলগুলোয় জরিপ ও খনন কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে সাগর এলাকায় গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানোর কথা। এর সঙ্গে সঙ্গে খনন কার্যক্রম চালানোর মাধ্যমে বিদ্যমান কূপগুলো থেকেও উত্তোলন বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যাতে জাতীয় গ্রিডে ২০২৫ সাল নাগাদ দৈনিক ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা যায়। কিন্তু এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সিলেট অঞ্চলেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। পার্বত্য এলাকা ও সাগরে অনুসন্ধান কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।

জ্বালানি বিভাগে সম্প্রতি বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনামূলক এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গ্যাস কূপ খনন, জরিপ, ওয়ার্কওভারসহ (সংস্কার) নানা কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকের কার্যপত্রেও সম্ভাব্য গ্যাস এলাকা জরিপ ও উত্তোলন বৃদ্ধির প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হচ্ছে সিলেট অঞ্চলকে ঘিরে। 

কার্যপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়াতে অন্তত ৮-১০টি প্রকল্পের কাজ চলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফসিএল), মার্কিন কোম্পানি শেভরন ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) এসব কূপ খনন সংস্কার ও ওয়ার্কওভারের কাজ করছে। এর মধ্যে সিলেট গ্যাসফিল্ডের সিলেট-১০ নম্বর কূপ খননের কাজ চলছে। কৈলাসটিলা-৮ নম্বর কূপ খননের কাজ চলতি মাসেই শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। রশিদপুর গ্যাসফিল্ডের আওতায় রশিদপুর-২, রশিদপুর-৫ এবং কৈলাসটিলা-২ কূপের ওয়ার্কওভার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডের অধীন বিবিয়ানা-২৭ উন্নয়নকূপ খনন করছে শেভরন। এছাড়া বিজিএফসিএলের আওতাধীন তিতাস গ্যাসফিল্ডের তিতাস-১৪ কূপ খননের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের স্থানীয় সরবরাহের প্রায় অর্ধেকই আসছে বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড থেকে। এ গ্যাসফিল্ডের মজুদ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্যদিকে তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রে এখনো বড় ধরনের মজুদ রয়েছে। এখান থেকেও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে। 

দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে পেট্রোবাংলা ৪৬টি কূপ খনন পরিকল্পনা করেছে। সংস্থাটির লক্ষ্য হলো এসব কূপের মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট যুক্ত করা। এ লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলছে এবং সেখান থেকে ভালো ফল পাওয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবি করছে পেট্রোবাংলা।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেসব কূপে কাজ চলছে, তার মধ্যে তিনটি কূপে ভালো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বড় ধরনের কোনো অঘটন না ঘটলে আগামী দুই মাসের মধ্যেই এর ফলাফল পাওয়া যাবে। সিলেট-১০ ও কৈলাসটিলায় যত গভীরে খনন করা হচ্ছে তার ফলাফলও তত ভালো পাওয়া যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী, যেসব গ্যাসফিল্ডে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেখানে আমরা ৫০০-৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট পাবই। দু-একটি কূপে নাও পেতে পারি। তবে পাব।’

ভোলার শাহবাজপুরে সম্প্রতি গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু ভোলার সঙ্গে পাইপলাইন সংযোগ না থাকায় সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। পেট্রোবাংলা বলছে, জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়বে যদি এসজিএফসিএল, বিজিএফসিএল ও শেভরনের কূপগুলোয় উত্তোলন বাড়ানো যায়। 

দেশে গ্যাস কূপ খনন যেমন সিলেট অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বড় কার্যক্রম চলছে, তেমনি সেখানেই গ্যাসের থ্রিডি ও টুডি জরিপ কার্যক্রম চলছে। যেসব এলাকায় গ্যাস কূপ খনন করছে, সেগুলো সিলেট অঞ্চলের গ্যাসের স্তরকে কেন্দ্র করে। এসব এলাকার গ্যাসফিল্ডের কূপগুলো কয়েক দশক আগ থেকেই উৎপাদনে রয়েছে। এছাড়া পরিত্যক্ত ও নতুন কূপের আওতায় গ্যাস পাওয়া গেলেও তা বর্তমান গ্যাস মজুদের হিসাবের বাইরে নয়। ফলে এখানকার গ্যাস উৎপাদন বাড়লেও তা যেমন যৎসামান্য তেমনি নতুন কোনো মজুদ আবিষ্কার নয়।

দেশে গ্যাসের টুডি ও থ্রিডি সিসমিক সার্ভে জরিপ চলছে বাপেক্স ও এসজিএফসিএলের আওতায়। এর মধ্যে বাপেক্স তাদের গ্যাস ব্লকের আওতাধীন ব্লক ১৫ ও ব্লক ২২-এ টুডি সিসমিক সার্ভে করছে। এ প্রকল্পের জন্য মোট ১৪৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। মূলত বাপেক্সের সঙ্গে চীনা কোম্পানি সিনোপ্যাক এ জরিপের বড় অংশে কাজ করবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।

বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, ব্লক ১৫ এলাকাটি ফেনী জেলার সোনাগাজী, দাগনভূঁইয়া, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ। অন্যদিকে ব্লক ২২-এ সিনোপ্যাক যে অঞ্চলটিতে জরিপ পরিচালনা করছে, সেটি হলো চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী ও পটিয়া।

গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে এবং নতুন গ্যাস মজুদের সন্ধান করতে পার্বত্য অঞ্চলে গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছিল বাপেক্স। গত কয়েক বছর বাপেক্সের এসব পরিকল্পনার কথা শুনলেও বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। তবে পার্বত্য অঞ্চলে এ কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে তা এখন পরিষ্কারভাবে বলতে পারছে না সংস্থাটি। বর্তমানে ভোলা ও বিদ্যমান গ্যাসফিল্ডগুলোয় কাজ করতে মনোযোগী সংস্থাটি। তবে এর একটি কারণও হতে পারে বলে সংস্থাটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

গত বছরের শুরুতে বাপেক্স শরীয়তপুরের নড়িয়ায় নতুন গ্যাস কূপ খননের কাজ শুরু করে। গ্যাস পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে এ কূপ খনন করা হলেও দীর্ঘ চার-পাঁচ মাস পর ফলাফল আসে শূন্য। সেখানে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) অর্থায়নে এ কূপ খননে সংস্থাটির ব্যয় হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। এ প্রকল্পে গ্যাস না পাওয়ার ব্যর্থতা থেকেই নতুন এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে সংস্থাটির মধ্যে অনাগ্রহ দেখা গেছে।

এদিকে, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) সংশোধন ও আধুনিকায়ন করা হলেও এখনো এ দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। সাগরে সবগুলো ব্লকে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিলের দেয়া প্রস্তাব বিশ্লেষণ ও কাজ দেয়া নিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক টানাপড়েন শুরু হওয়ায় এ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এখন এ দরপত্র কবে নাগাদ আহ্বান করা হবে কিংবা আদৌ বিদেশী কোম্পানি আসবে কিনা জ্বালানি বিভাগ থেকে শুরু করে পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে পেট্রোবাংলা ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট ২০২৫ সাল নাগাদ নির্ধারণ করেছে, তা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ যেসব কূপে গ্যাস অনুসন্ধান ও ওয়ার্কওভার করা হচ্ছে, সেখান থেকে যৎসামান্য গ্যাস পাওয়া যেতে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পেট্রোবাংলা গ্যাস বাড়ানোর যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেসব কূপে পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সেখানে এ পরিমাণ গ্যাস না-ও পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া এ পরিকল্পনায় নতুন উদ্যোগ যৎসামান্য। যেসব অনাবিষ্কৃত এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান করা দরকার, সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনেক বিলম্বিত। আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল ও সাগরে দ্রুত গ্যাস অনুসন্ধান জরুরি। কারণ আমাদের অনেক বেশি গ্যাসের সরবরাহ দরকার। যেহেতু আমাদের বড় গ্যাসফিল্ডের বৃহৎ সরবরাহ ও মজুদ শেষের দিকে। সেই হিসাবটিও পরিকল্পনায় বড় আকারে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন ছিল।’ 

আরও