মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আহরণে তলানিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাই ঋণ দেয়ার শর্ত হিসেবে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর লক্ষ্য দিয়েছে। বর্তমানে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটির শর্ত মানলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সে অনুপাত ৯ দশমিক ৫ শতাংশ করতে হবে। সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করছে। আমদানি শুল্ক (কাস্টমস) ও আয়কর থেকে আগামী তিন অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৯ লাখ ২২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি শুল্ক ৪ লাখ ২৭ হাজার কোটি ও আয়কর ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
সম্প্রতি আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে আমদানি শুল্ক ও আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণের এ লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরেছেন এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা যদিও বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ দুই খাত থেকে রাজস্ব আহরণ অনেকগুলো শর্তের ওপর নির্ভরশীল। সংস্কার করতে হবে অনেক কিছুই। ফলে এসব কারণে চাইলেও শিগগিরই এনবিআরের পক্ষে বড় আকারে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হবে না। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের নয় মাসেও ঘাটতি থাকা রাজস্বের অর্ধেকের বেশি আমদানি পর্যায়ের। এ খাতে ঘাটতির পরিমাণ ১৫ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যেখানে মোট রাজস্ব ঘাটতি ২৯ হাজার ৮ কোটি টাকা। অর্থবছরের বাকি তিন মাসেও রাজস্ব ঘাটতি অব্যাহত থাকবে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আরো কিছু সংস্কার ও পদক্ষেপের বিষয়েও আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। গত কয়েক বছরে রাজস্ব আহরণে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে। তাই আইএমএফের প্রোগ্রামের আওতায় বাড়তি রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এনবিআর কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিলেই তা পূরণ করা সম্ভব। আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে প্রাথমিক কাঠামো দাঁড় করা হয়েছে বলেও আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে রয়েছে ই-পেমেন্ট, ই-রিটার্ন ফিলিং, ই-টিডিএস, ই-অফিস ম্যানেজমেন্ট ও ই-টিআইএন সিস্টেম।
এনবিআরের দাবি, এসব পদক্ষেপে যদি যথাযথ অর্থায়ন, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও মানবসম্পদের সহায়তা পাওয়া যায়, তাহলে টেকসইভাবে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো যাবে। এছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স ও কর ফাঁকির জায়গাগুলো বের করা সম্ভব। যেখান থেকেও কর আহরণ বাড়ানো যাবে বলে মনে করে এনবিআর। পাশাপাশি ঝুঁকি বাছাই করে খাতভিত্তিক অডিটের মাধ্যমেও কর ফাঁকির জায়গা বের করা সম্ভব। কর আহরণ বাড়ানো যাবে কর প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেও। এনবিআর মনে করে, বর্তমানে ৩৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেয়া বাধ্যতামূলক করায় আয়করদাতার সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে এনবিআর ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের সঙ্গে যৌথভাবে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালুর বিষয়টিও কর আহরণ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
সরকারের রজস্ব আহরণের সংস্থাটি অবশ্য মনে করে, ডিজিটাল ইকোনমির ওপর কর আহরণ চ্যালেঞ্জিং। এজন্য ডিজিটাল ডিরেক্ট ট্যাক্সেশন ইউনিট নামে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট চালু করতে চায় এনবিআর। এর মাধ্যমে বিশাল ডিজিটাল জগত্ থেকে রাজস্ব আহরণ সহজ হবে। এছাড়া ভ্যাটের সঙ্গে আয়করের যৌথ অডিট, রিটার্ন পূরণ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক করের জন্য আলাদা ইউনিট চালু ইত্যাদি করা গেলে কর আহরণ বাড়বে। এজন্য তাদের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রশাসনিক সম্প্রসারণ, অবকাঠামো বাড়ানো, একই সঙ্গে যথাযথ লজিস্টিক সহায়তা জরুরি। পাশাপাশি কাস্টমসের রাজস্ব বাড়াতে এ খাতের অটোমেশন, জনবল বৃদ্ধি, লজিস্টিক সহায়তা, মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও বিগ ডাটা অ্যানালাইসিসে আরো বেশি বিনিয়োগ দরকার বলে মনে করে এনবিআর।
আমদানি পর্যায়ে শুল্ক আহরণ বাড়াতে এনবিআর এরই মধ্যে পণ্যে প্রি-অ্যারাইভাল ডকুমেন্টেশনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে বন্দরে আমদানীকৃত পণ্য পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তা খালাস করতে পারে। এছাড়া ই-অকশন, ই-পেমেন্ট, পণ্য আসার পর তা খালাস করতে কত সময় লাগছে সংস্থাটি সেজন্য টাইম রিলিজ স্টাডি (টিআরএস), অথরাইজ
ইকোনমিক অপারেটর (এইও), ন্যাশনাল
সিঙ্গেল উউন্ডোসহ (এনএসডব্লিউ) বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কাস্টমসের বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবেলায় ‘কাস্টমস
রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ নামে আলাদা কমিশনারেট প্রতিষ্ঠা করেছে এনবিআর। বর্তমানে এ কমিশনারেট অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যার থেকে তথ্য নিয়ে ঝুঁকি নিরসনে কাজ করছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের আওতায় অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের মূল সফটওয়্যার কেনার কার্যক্রমও প্রক্রিয়াধীন বলে আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এনবিআরের
সবচেয়ে বেশি দরকার পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, যার জন্য এখন পর্যন্ত জনবল বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালেই এনবিআরে জনবল নেয়ার অনুমোদন ছিল। শীর্ষ ডিফল্টারের তালিকায় রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছ থেকেও সঠিকভাবে কর আহরণ করতে হবে। তা না হলে এনবিআরের রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হবে না।’
আবদুল মজিদ বলেন, ‘রাজস্ব
আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল পাওয়া যায় না। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা রয়েছে এনবিআরের। এজন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়নের ওপরও জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে এনবিআরের ভেতরেই ব্যাপক সংস্কার জরুরি।’