রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

ডামি ফুয়েলে পরীক্ষামূলক, সঞ্চালন লাইন শেষ করতে আরো এক বছর

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ পর্যায়ে। প্রথম ইউনিটের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ হয়েছে ৭০ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে ফুয়েল লোডের (ইউরেনিয়াম) সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার আগে ডামি ফুয়েলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়ে দেখা হবে। আর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ কবে হবে, তা নির্ভর করছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সঙ্গে

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ পর্যায়ে। প্রথম ইউনিটের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ হয়েছে ৭০ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে ফুয়েল লোডের (ইউরেনিয়াম) সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার আগে ডামি ফুয়েলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়ে দেখা হবে। আর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ কবে হবে, তা নির্ভর করছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সঙ্গে সংযুক্ত সঞ্চালন লাইনগুলোর কাজ শেষ হওয়ার ওপর। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন শেষ হতে সময় লাগবে আরো এক বছরের বেশি।

যেকোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম (জ্বালানি) ফুয়েল রিঅ্যাক্টরে স্থাপনের আগে কয়েক ধাপে ডামি ফুয়েল দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়। ডিসেম্বরের মধ্যেই এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশাবাদী প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। যদিও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ শেষ না হওয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে কবে যুক্ত করা যাবে সে বিষয়ে এখনো সংশয়ে রয়েছেন তারা। 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে চারটি সঞ্চালন লাইন সংযুক্ত হওয়ার কথা। এগুলো হলো ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপপুর-বাঘাবাড়ী সঞ্চালন লাইন, ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপপুর-বগুড়া, ১৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপপুর-গোপালগঞ্জ ও ১৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপপুর-ঢাকা সঞ্চালন লাইন। 

‘কনস্ট্রাকশন অব ৪০০ কেভি অ্যান্ড ২৩০ কেভি রিভার ক্রসিং ট্রান্সমিশন লাইন ফর পাওয়ার ইভাক্যুয়েশন অব নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট অন যমুনা অ্যান্ড পদ্মা রিভারস’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় লাইনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির আওতায় এর মধ্যে রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইনের কাজ শেষ হয়নি। ৪০০ কেভি সিঙ্গেল লাইন চালু করার জন্য দুই কিলোমিটার পদ্মা নদী পারাপারের (রিভার ক্রসিং) কাজ এখনো চলমান। রূপপুর-ঢাকা সঞ্চালন লাইনের মধ্যে নদী পারাপার আছে ১৪ কিলোমিটার। গোটা সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের এ অংশকেই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছে পিজিসিবি। 

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পিজিসিবির এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্পে নদী পারাপার (রিভার ক্রসিং) অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। অর্থায়ন জটিলতা, প্রকল্পের লোকবল সংকটে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ থেমে ছিল। এ কাজ শেষ হতে এক বছর বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে অন্তত দেড়-দুই বছর সময় প্রয়োজন।’

সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, ২০২৫ সালের জুন নাগাদ বড় সঞ্চালন লাইনগুলোর কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও পিজিসিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘ এ সঞ্চালন প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ১৪ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ১৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম গাউছ মহীউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রূপপুরের সঙ্গে সংযুক্ত বেশ কয়েকটি সঞ্চালন লাইন রয়েছে। এর মধ্যে ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভি রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইন বাদে বাকি লাইনগুলো আমরা চালু করেছি। চলতি বছরের শেষ নাগাদ রূপপুর চালু হলে প্রস্তুত হওয়া লাইনগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু করা সম্ভব। বর্তমানে যে সঞ্চালন লাইনের কাজটি চলছে সেগুলোর পদ্মা ও যমুনার রিভার ক্রসিংয়ের কাজ চলছে। আমরা রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। আশা করি কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট পুরোপুরিভাবে চালু হওয়ার আগেই সব সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হবে।’

রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অন্য কেন্দ্রগুলোর চেয়ে আলাদা। কোনো একটি সঞ্চালন লাইনের কাজ অবশিষ্ট থাকলে তা রূপপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রমে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সঞ্চালন অবকাঠামো প্রস্তুত করা নিয়ে রূপপুর প্রকল্পের রাশান জেনারেল কন্ডাক্টর, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা এরই মধ্যে দফায় দফায় বৈঠকও করেছেন। তবে তাদের এসব বৈঠকে রূপপুরের বিদ্যুৎ কবে নাগাদ গ্রিডে সরবরাহ সম্ভব হবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর উপযোগী হওয়ার সময় এর সঞ্চালন অবকাঠামো প্রস্তুত থাকাটাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ এটি অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম এর আগে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর জন্য আন্তর্জাতিক গাইডলাইন রয়েছে। এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর জন্য অন্তত চারটি ধাপ রয়েছে। বিশেষ করে কেন্দ্রটি চালুর আগে প্রি-কমিশনিং কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। সেখানে কোল্ড টেস্ট-হট টেস্ট করতে হয়। এরপর প্রকৃত জ্বালানি ব্যবহার করে শূন্য পাওয়ার থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ফুল পাওয়ারে যেতে হয়। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ে ফুয়েল লোড করতে হয়। এসব কাজ করতে প্রতিটি পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান রেগুলেটরি বডিকে দিতে হয়। এরপর কেন্দ্রটি চালু করা যায়।’

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর জন্য যাবতীয় প্রস্তুতির কাজ শেষ পর্যায়ে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশের টেস্টিং কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটি করতে অন্তত পাঁচ-সাত মাস সময় লাগতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিটি যন্ত্রাংশের সফল পরীক্ষার ওপর। চূড়ান্তভাবে এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শেষ হলে আগামী ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিটের ফুয়েল লোড (ইউরেনিয়াম) করা হবে। যেটিকে বলা হচ্ছে এ প্রকল্পের ফিজিক্যাল স্টার্টআপ। এ কার্যক্রমের আগে আইএইএর মিশন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করবে। আইএইএর সার্টিফিকেট পাওয়ার পর পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের লাইসেন্স পাওয়া যাবে। 

রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ সার্বিকভাবে ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে প্রথম ইউনিটের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের টেস্টিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ফুয়েল লোড (জ্বালানি) হবে। এটি দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন ধরনের মেশিনারিজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে। সেটির বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যক্রম রয়েছে। এ কার্যক্রম সফলভাবে শেষ হলে ফাইনাল পর্যায়ে পাওয়ার স্টার্টআপ কাজ শুরু হবে। এ কার্যক্রম রূপপুর ও পিজিসিবি দুই অংশের সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে রূপপুরে জেনারেল কন্ডাক্টর, পিজিসিবি বৈঠক হয়েছে। কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ দ্রুত গ্রিডে দিতে সব পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চলছে।’

প্রকল্পের পূর্বনির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রথম ইউনিটের এবং ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। শিডিউল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথম ইউনিট আর ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর দ্বিতীয় ইউনিটের চূড়ান্ত হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে এখন এ প্রকল্পের সময়সীমা দুই বছর পিছিয়ে আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জয়েন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির এক সভায় প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অনুমোদন হয়।

প্রসঙ্গত, পাবনার রূপপুরে নির্মীয়মাণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। এ প্রকল্পে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ অর্থায়নের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় রাশিয়া। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধ (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত ঋণ বাবদ ছাড় হয়েছে সর্বোচ্চ প্রায় ৬২৭ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এরই মধ্যে প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ শেষও হয়েছে। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম দেশে এসেছে, যা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আরও