প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়, সেজন্য পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতি সমান আচরণ ও ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন সে পরিবেশ নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব।’ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটরিয়ামে গতকাল তিন দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি এ কথা বলেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনের আগের সময়টা অনেক কঠিন। তাই পুলিশকে সজাগ থাকতে হবে পরাজিত শক্তি যেন কোনোভাবেই দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে। অশুভ শক্তি আমাদের স্বপ্ন ও ঐক্য ভেঙে দিতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে চেষ্টা করছে। একে প্রতিহত করতে পুলিশকে সজাগ থাকতে হবে।’
নারীদের সেবা দেয়ার বিষয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যেকোনো ঘটনায় নারীরা যেন পুলিশের হটলাইন নম্বরে কল দিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পায় সেটি নিশ্চিত করবেন। নারী ও শিশু নিরাপত্তা পেলে আমরা বুঝতে পারব দেশ নিরাপত্তার দিকে অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা জানি পুলিশ বাহিনীর সামনে অনেক সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অপ্রতুল জনবল, লজিস্টিকস, পর্যাপ্ত বাজেট ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিগত বছরগুলোয় পুলিশ ও জনগণের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা কমিয়ে আনা। পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। আমি বলব এটি কঠিন নয়। একবার সে আন্তরিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে এ বন্ধন অটুট থাকবে। আমাদের সমাজ একটি সুশৃঙ্খল সমাজ, সেটি প্রমাণিত হবে।’
স্বৈরাচারী শাসনামলের ১৫ বছর দেশের পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করার সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারের অবৈধ, অন্যায় আদেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশ বাহিনী ব্যাপকভাবে জনরোষের মুখে পড়ে। অনেক সৎ পুলিশ সদস্যকেও এজন্য মাসুল দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ২৫ মার্চ কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর গৌরবময় ইতিহাসে এটা গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। আজকের দিনে আমি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’
পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নেয় সে সময় এ দেশের আইন-শৃঙ্খলা ছিল ভঙ্গুর অবস্থায়। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব রকমের ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও জনদুর্ভোগ নিরসন, বিশেষ অভিযান পরিচালনা, অংশীজনের সঙ্গে পুলিশের আন্তঃযোগাযোগ জোরদার করা, পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গা পূজা, বিশ্ব ইজতেমা, ঈদুল ফিতর, বাংলা নববর্ষসহ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশে যতগুলো অপরাধ হচ্ছে সব ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।’ এজন্য ড. ইউনূস পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘সর্বস্তরের মানুষের অধিকার, মর্যাদা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, কোনো বৈষম্য থাকবে না—যুগ যুগ ধরে এটাই দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে জোর ভূমিকা রাখতে হবে।’
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বিকালে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এ সময় তিনি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার, সেবার মানসিকতা ও আন্তরিকতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে হবে। এর মাধ্যমে পুলিশের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। সাধারণ মানুষ যেন কোনো রকম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে। কারো কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নেয়া যাবে না। ঘুস, দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিন দিনব্যাপী এ আয়োজনে উদ্বোধনী দিনেই এবার পদকের জন্য ঘোষিত ৬২ কৃতী পুলিশ সদস্যকে পদক পরিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টা। এবারের পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ‘আমার পুলিশ, আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’। অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত আইজি, সব মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপারসহ সব পদবির পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।