মুন্সিগঞ্জে গত তিন বছরে আলু আবাদ কমেছে

লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে কৃষকের

আলু উৎপাদনের শীর্ষে থাকা জেলা মুন্সিগঞ্জে কমছে আবাদ। দেশের মোট আলুর চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়েছে মুন্সিগঞ্জের আলু।

আলু উৎপাদনের শীর্ষে থাকা জেলা মুন্সিগঞ্জে কমছে আবাদ। দেশের মোট আলুর চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়েছে মুন্সিগঞ্জের আলু। তবে ২০২১-২৩ তিন বছরে মুন্সিগঞ্জে আলু আবাদ কমেছে। কৃষক পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পেয়ে ভারী হয়েছে লোকসানের পাল্লা। এতে আলু আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চাষীরা। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই পেশা বদল করেছেন বলে অভিযোগ কৃষকের। আর কৃষকের আগ্রহ হারানোর পেছনে ফড়িয়াদের দায়ী করছে কৃষি বিভাগ।

মুন্সিগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে ৩৫ হাজার ৭৯৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে মাত্র ৩৪ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে। ২০২২ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টরে, আবাদ হয়েছিল ৩৫ হাজার ৭৯৬ হেক্টরে। ২০২১ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টরে, আবাদ হয়েছিল ৩৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে।

প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয় মুন্সিগঞ্জে। জেলার ৬৮টি কোল্ডস্টোরেজের ধারণক্ষমতা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন। তাই উৎপাদিত বাকি আলু নিয়ে প্রতি বছরই কৃষককে হিমশিম খেতে হয়। এবার কোল্ডস্টোরেজে (হিমাগারে) সংরক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তোলন শেষে কম লাভে জমি থেকেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন অধিকাংশ কৃষক। জেলার ৬৩টি হিমাগারে চাহিদার চেয়েও দ্বিগুণ পরিমাণ আলুর মজুদ থাকলেও দেড় মাসের ব্যবধানে খুচরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কয়েক দফা বেড়েছে দাম। সাধারণ ক্রেতাদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের যথাযথ বাজার তদারকি না থাকায় নানা অজুহাতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়িয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে নিয়ে বাজারে নানা অজুহাত রয়েছে খুচরা ব্যবসায়ীদের। তাদের দাবি, বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় বাড়ছে আলুর দাম। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, এখনো পর্যাপ্ত আলুর মজুদ রয়েছে জেলার বেশির ভাগ হিমাগারে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার ৬৭টি হিমাগারের মধ্যে বর্তমানে সচল থাকা ৬৩টি হিমাগারে ( সেপ্টেম্বর) মজুদ রয়েছে লাখ ২১ হাজার ২১১ টন আলু। এর মধ্যে খাবার আলু মজুদ রয়েছে লাখ ৩৫ হাজার ৮৫২ টন। আর বীজ আলুর মজুদ রয়েছে ৭৭ হাজার ৫৮১ টন। খুচরা বাজারে কয়েক দফা মূল্য বৃদ্ধির পর বিগত তিন মাসে হিমাগার থেকে বাজারজাত হয়েছে ৫৫ হাজার ১৮৮ টন আলু।

এদিকে চলতি বছর মুন্সিগঞ্জে হেক্টরপ্রতি আলু উৎপাদনে গড়ে খরচ হয়েছে লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে ৩০ দশমিক ৭৫ টন আলু। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন পরিবহন খরচসহ সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজিতে ১১-১৩ টাকা। বর্তমানে হিমাগারের মজুদকৃত এসব আলু প্রায় কয়েক গুণ বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪১-৪৬ টাকা পর্যন্ত।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উৎপাদিত আলুর প্রায় ৯৩ শতাংশ কৃষক বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে এখনো কিছুসংখ্যক কৃষকের আলু মজুদ রয়েছে হিমাগারে। বাকি সবটুকুই ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে বাজারে আলুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হলেও প্রকৃত কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন। আর হিমাগারগুলোয় হাত বদলেই বাড়ছে আলুর দাম।

আজিজ মিয়া নামে এক কৃষক বলেন, ‘আমি ২৫-৩০ বছর আলু আবাদ করছি। টানা বেশ কয়েক বছর লোকসান হলেও থেমে যায়নি, চলতি মৌসুমে ফলন কিছুটা কম হয়েছে। তবু এবার সদর উপজেলার চরকেওয়ার এলাকায় প্রায় ১০৯ একর জমিতে বছর আলু আবাদ করেছি। চলতি বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহের দিকে জমি থেকে আলু উত্তোলন শেষে -১০ টাকা কেজি দরে প্রতি কেজি আলু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছি। মাত্র পাঁচ-ছয় মাসের ব্যবধানে এসব আলু এখন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে অন্তত তিন গুণ বেশি দামে। ১০ টাকা কেজি দরের আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা কেজিতে।

আলু ব্যবসায়ী রসরাজ বাবু বলেন, ‘চলতি মৌসুমে পাঁচ হাজার বস্তার বেশি আলুর সংরক্ষণ করেছি হিমাগারে, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে সংরক্ষণ ব্যয়। এখনো আমার প্রায় দুই হাজার বস্তার বেশি আলু মজুদ রয়েছে মুক্তারপুর এলাকার রিয়ারভিউ কোল্ডস্টোরেজে। মজুদকৃত এসব আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩-২৭ টাকা কেজিতে। ৫০ কেজি ওজনের একেকটি আলুর বস্তা প্রায় হাজার ৪০০ টাকা। আমরা তো পাইকারি আলু ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক দামেই খুচরা ব্যবসায়ী বাজারের আড়তদারদের কাছে আলু বিক্রি করছি। তবে কেন তারা খুচরা বাজারে আলুর দাম বৃদ্ধি করছে বিষয়টি প্রশাসনের খতিয়ে দেখা উচিত। বাজারে আলুর দাম বৃদ্ধি নিয়ে অস্থিরতার পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ঢাকার বড় আড়তদাররা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আলু রোপণ মৌসুম থেকে শুরু করে উত্তোলন পর্যন্ত কৃষককে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। তবে তাদের আলু বিক্রি করে দেয়ার পর ফড়িয়াদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই কৃষি বিভাগের।

জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, ভোক্তা পর্যায়ে লিখিত অভিযোগ পেলেই নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থা। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ৪৫ ধারায় কোনো লিখিত অভিযোগ পেলেই বাজারগুলোয় অভিযান চালিয়ে নেয়া হচ্ছে আইনগত ব্যবস্থা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কোল্ডস্টোরে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত আলু মজুদ রাখা পাইকারি ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি খুচরা বাজারেও অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবু নিয়ন্ত্রণে আসছে না পরিস্থিতি। শিগগিরই জোরালো পদক্ষেপে যেতে হবে আমাদের। বিশেষ করে আলুর দাম স্বাভাবিক রাখতে। তবে মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যে কারণটি খুঁজে পাওয়া গেছে তা হচ্ছে হিমাগারে থাকা আলু মজুদ অবস্থায় কয়েক দফা হাতবদলে বাড়ছে দাম।

আরও