ব্যাংকগুলোর ডলার ধারণ বাড়লেও চাপ এখনো কমেনি

দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার স্থিতি বেড়েছে। জুলাই শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯০ কোটি বা ৫ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুলাইয়ে এ স্থিতি ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। সে হিসাবে ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ডলার স্থিতি বেড়েছে ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তবে বিদ্যমান দায়-এর তুলনায় ব্যাংকগুলোর ডলার স্থিতি এখনো

দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার স্থিতি বেড়েছে। জুলাই শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯০ কোটি বা ৫ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুলাইয়ে এ স্থিতি ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। সে হিসাবে ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ডলার স্থিতি বেড়েছে ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তবে বিদ্যমান দায়-এর তুলনায় ব্যাংকগুলোর ডলার স্থিতি এখনো অনেকটাই কম। এ কারণে আমদানির ঋণপত্রের (এলসি) দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোকে এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। এতে দিন যত যাচ্ছে বাড়ছে রিজার্ভের ক্ষয়। আগস্টের প্রথম ২৩ দিনেই রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে ১৯ কোটি ডলার।

চলতি বছরের জুলাইয়ে আমদানির নতুন এলসি কমেছে ৩১ শতাংশেরও বেশি। একই সময়ে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২০ শতাংশ। মূলত আমদানির লাগাম টেনে ধরার কারণেই বাজারে ডলার সংকটের তীব্রতা কিছুটা কমেছে। তবে আবারো ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠার বার্তা দিচ্ছে রেমিট্যান্সের বড় পতন। জুলাইয়ে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের প্রবাহ কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। এ পতন চলতি আগস্টেও অব্যাহত রয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ডলারের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। তবে এখনো অনেক ব্যাংক যথাসময়ে আমদানির এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে বিদেশী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে তাদের তিক্ততা বাড়ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর জন্য নিজেদের ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে বিদেশী বড় ব্যাংকগুলো। আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডি’স ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দেয়ার পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। 

দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিনও মনে করেন দেশে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত বছর দেশের ব্যাংকগুলোর ডলার হোল্ডিং ৫০ কোটি ডলার ঋণাত্মক ছিল। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলোর ডলার হোল্ডিং সাড়ে ১২ কোটি ডলার পজিটিভ। সার্বিকভাবে পেমেন্টের চাপও কমেছে। এর প্রমাণ হলো দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চলতি হিসাব ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। আমার মনে হয়, আর মাত্র দুই মাস এ পজিটিভ পজিশনে শেষ করতে পারলে আমাদের জমে থাকা পেমেন্ট পুরো শেষ হয়ে যাবে।’ 

রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি মানছে না জানিয়ে মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘গত সপ্তাহে ব্যাংকার্স সভায় স্বয়ং গভর্নর এত কড়াভাবে বলার পরও এখনো অনেক ব্যাংক বেশি রেটে ডলার এনে মার্কেট ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দুটোই নষ্ট করছে। আগে সিটি ব্যাংক মাসে রেমিট্যান্স আনত ৭০ মিলিয়ন ডলার। এখন নিয়ম মানায় আমাদের ব্যাংকের রেমিট্যান্স নেমে এসেছে মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলারে। সিটি ব্যাংকের তো সুনাম এ সময়ে কমেনি, বরং বেড়েছে। তাহলে আমি ডলার পাচ্ছি না কেন? এটার একটা বিহিত হওয়া দরকার। আমার একটাই চাওয়া, রেগুলেটর নিশ্চিত করুক যেসব ব্যাংক রেমিট্যান্সে সমান রেট দিচ্ছে। এটি হলে মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ আড়াই বিলিয়ন ডলারে উঠবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালের জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে থাকা ডলারের রিজার্ভ ছিল ৬০০ কোটি ৭৩ লাখ বা ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এরপর থেকে দেশে ডলারের সংকট বাড়তে থাকে। ফলে ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো হিসাবে ডলারের পরিমাণও কমে যায়। গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংকগুলোর এ রিজার্ভের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। এরপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। চলতি বছরের ৩১ জুলাই দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে রিজার্ভ ডলারের স্থিতি ছিল ৫৯০ কোটি, যা জুনের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। আর ২০২২ সালের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোর বিদেশী হিসাবে ডলারের স্থিতি ছিল ৪৮৮ কোটি ১৫ লাখ। সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় ব্যাংকগুলোর ডলারের রিজার্ভ ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাংকগুলো মূলত আমদানির এলসি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের জন্য বিদেশী হিসাব বা নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ডলার সংরক্ষণ করে। 

চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৯৭ কোটি ডলার ছিল ডেফার্ড পেমেন্ট বা বিলম্বিত দায়। মূলত যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের এ বিদেশী ঋণ তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এ তিন মাসে ১ হাজার ৪৩৮ কোটি ডলারের নতুন এলসি খোলা হবে। এর মধ্যে ব্যাক টু ব্যাক এলসির সম্ভাব্য দায়ের পরিমাণ হবে ২৫০ কোটি ডলার।

রিজার্ভের অব্যাহত ক্ষয় ও ডলার সংকটের কারণে বিদেশী অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের বেসরকারি খাত থেকে নিজেদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ কারণে গত ছয় মাসে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ ২৭৬ কোটি ডলার কমেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে এ ধরনের বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ স্থিতি ১৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে এ সময়ে ব্যাংকগুলোর বিলম্বিত এলসি দায় বা ডেফার্ড পেমেন্ট না কমে উল্টো বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ডেফার্ড পেমেন্টের স্থিতি ছিল ৬৯ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে বিলম্বিত এ দায়ের স্থিতি ৯৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি অন্য বিদেশী ঋণের মধ্যে ৭৬৯ কোটি ডলার হলো বায়ার্স ক্রেডিট। এছাড়া সরাসরি স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ হলো ৩৫৪ কোটি, ব্যাক টু ব্যাক এলসি ৮৪ কোটি ও অন্যান্য দায় ৬০ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক আমদানির এলসি দায় পরিশোধে প্রতিদিনই ব্যর্থ হচ্ছে। এসব ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ দায়ের পরিমাণ এখন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। সরকারি এলসির পাশাপাশি বেসরকারি খাতের এলসি দায়ও পরিশোধ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। দিনের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডলার সংগ্রহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ধরনা দেয়া। প্রতিদিনই এ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিলিয়ন ডলার কেনার প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিক্রির পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ কোটি ডলারে সীমাবদ্ধ থাকছে। আবার ৮-১০টি বেসরকারি ব্যাংকও এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রার বাজার পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেকোনো দেশের অর্থনীতিতেই কিছুটা শঙ্কা ও উদ্বেগ থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় আছে। বিপরীতে আমদানি ব্যয় অনেক কমে এসেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগের মতো বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে না। আমি মনে করি, জাতীয় নির্বাচনের পর ডলার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

আরও