বেহাত বিপ্লবের শুরুটা হয় বেহাত পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আওয়ামী লীগকে একই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিয়োজিত নাকি পুনর্বাসিত হতে যাচ্ছে? জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত নিহতের সংখ্যার ওজন আওয়ামী লীগকে টিকে থাকতে দেবে কিনা সেটির সুলুক সন্ধানের পূর্বে পরিসংখ্যানের কিছু পাঠ নেয়া যাক।

দুই হাজার পাঁচ সালের দিকে মিলেনিয়ালরা যখন কিশোর বয়স পার করছে, বর্তমানের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী দুটি জনপ্রিয় টেলিফিল্ম বানিয়েছিলেন, “‍‌স্পার্টাকাস ’৭১” এবং ‘‌এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। প্রায় আজ থেকে ২০ বছর আগে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের ক্ষমতার শেষের দিকে টেলিফিল্ম দুটি এতটাই দর্শকনন্দিত হয়েছিল যে তার প্রতিফলন দেখা গেছে ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের দিন বদলের নির্বাচনী ইশতেহারে; অথবা উল্টোটিও ঘটতে পারে। স্পার্টাকার্স ’৭১ নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে, সেই সময়ে এক নিরীহ পরিবারের কর্তা আব্দুল করিম নির্ঝঞ্ঝাটভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শান্তি কমিটির ক্লিন শেভড লিডার মাহবুব তাকে সেই শান্তির জীবন যাপন করতে দেয়নি। বরং তার দুই জমজ ছেলে শাওন-বাঁধনকে পাকিস্তানি মিলিটারির কাছে ধরিয়ে দেয়। বাড়ির উঠানেই দুজনকে মেরে ফেলা হয়। এ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আব্দুল করিম গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন, প্রথম কিস্তি সেখানেই শেষ। টেলিফিল্মটির সিক্যুয়াল ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’-এ সময় লাফ দিয়ে পৌঁছে যায় একবিংশ শতাব্দীতে, যেখানে দেখা যায় সেই শান্তি কমিটির মাহবুব, দাড়ি-গোঁফে আবিষ্ট আলখেল্লা পরা রাশভারী ভদ্রলোক, ২০০৫ সালের দিকে একজন মন্ত্রী যাকে পাতি নেতারা জনসাধারণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হিসেবে পরিচয় করে দিচ্ছে। তৎকালীন সময়ে ঘটনাটির সঙ্গে অনেকেই হয়তো সত্যের সঙ্গে মিল খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, সেই চেষ্টার ধারাবাহিকতায় বোধহয় প্রশ্ন করা শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্বাসনের প্রসেস ঠিক কী ছিল? মূলত একটি গণহত্যা বা এথনিক ক্লিনজিংয়ের পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হয়, ওই ঘটনায় জড়িত মানুষের বিচার কীভাবে হবে বা কোন পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হবে, সর্বোপরি পুনর্বাসনই ঠিক কীভাবে করা হবে? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঠিক কাদের পুনর্বাসন করা হবে?

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আওয়ামী লীগকে একই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিয়োজিত নাকি পুনর্বাসিত হতে যাচ্ছে? জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত নিহতের সংখ্যার ওজন আওয়ামী লীগকে টিকে থাকতে দেবে কিনা সেটির সুলুক সন্ধানের পূর্বে পরিসংখ্যানের কিছু পাঠ নেয়া যাক। আগস্টে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিসি) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন সংখ্যাটিকে সহস্রাধিক বলেছেন (বিবিসি, ১৭ আগস্ট ২০২৪)। তবে সেপ্টেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলামের বরাত থেকে জানা যায় সংখ্যাটি ১ হাজার ৪২৩ (দেশ রূপান্তর, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০তম দিন উপলক্ষে সরকারপ্রধান ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস নিহতের সংখ্যা আনুমানিক ১ হাজার ৫০০ এবং আহতের সংখ্যা ১৯ হাজার ৯৩১ দাবি করেছেন (ডেইলি স্টার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪)। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংখ্যার বিচারে এত বড় রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যাযজ্ঞ এ তল্লাটে হয়নি। এখন প্রশ্ন হতে পারে, আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ড গণহত্যা কিনা? জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী জেনোসাইড বা গণহত্যার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। সেটি অনুসারে কোনো জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে সেই গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা, তাদের শারীরিক ধ্বংসের উদ্দেশ্যে জীবনযাপনের শর্ত আরোপ, জন্মনিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শিশুদের জোরপূর্বক অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর করা হলে সেটি গণহত্যা বা জেনোসাইড বলা হয়। এর বিপরীতে, মাস-মার্ডার বলতে বিপুলসংখ্যক মানুষের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড বোঝায়, যা অবশ্যই কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত করা হয় না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে এটিও মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়তে পারে। জেনোসাইড ও গণহত্যার বিষয়ে গবেষণাকারী মনোবিজ্ঞানী এরভিন স্টাউবের (২০০০) মতে, জেনোসাইড মূলত গোষ্ঠীকেন্দ্রিক এবং পরিকল্পিত হয়, অন্যদিকে মাসকিলিং হতে পারে এলোমেলোভাবে, যেমন সামরিক অভিযানে বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে হয়ে থাকে (Genocide and Mass Killing: Origins, Prevention, Healing and Reconciliation)।

মাসমার্ডার বা জেনোসাইড যে সংজ্ঞায়নে ফেলা হোক না কেন, সেটির বড় ধরনের পরিণতি, ইংরেজিতে যেটিকে বলে ট্র্যাজিক কনসিকোয়েন্স রয়েছে। অতীত ইতিহাসে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ফ্যাসিবাদী দলগুলোর অনুরূপ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পতনের পর কি হয়েছিল তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত বড় নজির হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা নাৎসি পার্টির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চালানো গণহত্যা। তবে হিটলারের পতনের পরও জার্মান সমাজকে নিয়ে মিত্রশক্তির দেশগুলো অনেকগুলো কারণে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি দেখা যায় তাহলো মূল জনগোষ্ঠীর বিরাট এক অংশ নাৎসি পার্টির সদস্য ছিল, সংখ্যার বিচারে ৮০ লাখ যা ওই সময়ের জার্মানির জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। বড় বড় বিজ্ঞানী বা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দেশটির মুচি পর্যন্ত অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নাৎসি পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিল। এই যেমন গাড়ি নির্মাণকারী বিএমডব্লিইউ বা পোরশে, ক্রুপ ও সিমেন্সের মতো প্রতিষ্ঠান, একে তো সবার বিচার করা প্রায় অসম্ভব ছিল, আবার অনেকেই গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতও ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলাপ আসা মানেই নুরেমবার্গ ট্রায়ালের কথা চলে আসবে, সেই ট্রায়ালে গণহত্যার পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা বা বাস্তবায়নকারীদেরই মূলত বিচার হয়েছে। কিন্তু একজন সাধারণ যে নাৎসি পার্টির মেম্বার তাকে এ ধরনের বড়সড় বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কার্যত স্নায়ুযুদ্ধের যুগ শুরু হয়, সেই অস্থির সময়ে জার্মানিকে মোটাদাগে চার ভাগে শাসন করা হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ইচ্ছামতো জার্মানির ভৌগোলিক অঞ্চল নিজেদের করায়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসে, তখন দেশগুলো নিজেদের মতো করে ডিনাজিফিকেশন প্রোগ্রাম হাতে নেয়। ইতিহাসবিদ মাইকেল ড্যাকের Everyday Denazification in Postwar Germany (২০২৩) বই থেকে জানা যায়, এই প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে নৃশংসতার জন্য দায়ী একটি আদর্শকে কাঠগড়ায় তোলা যায় এবং সেই সঙ্গে এটিও নিশ্চিত করা যাতে নাৎসিবাদ বা ফ্যাসিবাদের মতো কোনো মতবাদ আর কখনো জার্মানিতে না ফিরে আসে।

ডিনাজিফিকেশনের ক্ষেত্রে ফ্রান্স সবচেয়ে লঘু পন্থা অবলম্বন করে; ব্যক্তির বিচারের চেয়ে সিস্টেমের বিচারে আগ্রহী ছিল। ফলে বিচারকার্যের চেয়ে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ওপর জোর দিয়েছিল। কিন্তু ঝামেলা বাধে, যখন দেখা যায় সব নাৎসি-সম্পৃক্ত আমলা ও শিক্ষককে সরিয়ে দিলে এক ধরনের শ্রম ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং ফরাসি দখলকৃত এলাকায় মাত্র ১৩ জন ব্যক্তির বিচার হয়। ১৯৪৫ সালের ৭ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ফ্রাঙ্কফুর্ট কনফারেন্সে মার্কিনি ডিপ্লোমেট রবার্ট ডেনিয়াল মার্ফির ডিপ্লোমেটিক পেপারে অবশ্য কঠোর নির্দেশনা ছিল। যেমন নাৎসি পার্টির মেম্বার যারা তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ইত্যাদি, যার সবকিছু সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ফ্রান্সের নেয়া এ লঘু শাস্তি প্রকল্পের ফলে ফ্রাঙ্কো-জার্মান সম্পর্ক অনেকখানি ভালো হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের কৌশল প্রতিশোধের চেয়ে পুনর্মিলনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, যার ফলে ১৯৪৫ সালের পর দুই জাতির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল যা এখনো বিরাজমান।

ব্রিটেন সংস্কৃতির তুলনায় অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল। তারা প্রাথমিকভাবে নাৎসিদের সঙ্গে ওঠা-বসা করা পেশাজীবী এবং শিল্পপতিদের পুনরায় কাজ করার অনুমতি দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী প্রভাব মোকাবেলার চেষ্টা করবে। বিএমডব্লিউ বা সিমেন্সের মতো নাৎসি অর্থায়নকারী কোম্পানিগুলো তুলনামূলক খুব কম শাস্তি পায়। ধারণা করা হয়, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোমতে পার পেয়ে যায়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সহকারী অধ্যাপক আরতেমিজ তাঁর গবেষণায় (Un-British No More: Torture and Interrogation by Britain in Germany, 1945–54) উল্লেখ করেছেন, ব্রিটেন সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য অনেকগুলো পদ্ধতি অবলম্বন করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্মম জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, পরবর্তী সময়ে এগুলো অমানবিক নির্যাতন হিসেবে প্রমাণিত হয়।

ডিনাজিফিকেশন প্রোগ্রামের সবচেয়ে অদ্ভুত পদ্ধতি নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৮ বছর বয়সীদের সবার জন্য ফর্ম বিলি করে সেটির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কাজটি অদ্ভুত, কারণ পুরোটাই হয়েছিল অ্যানালগ পদ্ধতিতে এবং লাখ লাখ ফর্মের যাচাই-বাছাই করা ছিল কষ্টসাধ্য কাজ। সেই তথ্যের মাধ্যমে তারা বোঝার চেষ্টা করেছিল যে একজন জার্মান ঠিক কতটুকু নাৎসিদের চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত। সেখান থেকে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কারা কতটুকু অপরাধী, সেই অপরাধের ওপর ভিত্তি করে তারা সার্টিফিকেট দিত। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, সেই সার্টিফিকেট কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে। ওপরে উল্লিখিত মাইকেল ড্যাকের বই থেকে জানা যায়, প্রোগ্রামটি এ কারণেই ব্যর্থ হয়। ফলে ১৯৫০ সালে এ কার্যক্রম তারা অফিশিয়ালি বাতিল করে। তবে মিডিয়া ও কালাচারাল ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নাৎসিদের আইডিয়ার প্রতি ঘৃণা ছড়ানো দীর্ঘমেয়াদে চালাতে থাকে। রেডিও, নাটক, সিনেমা বা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে নাৎসিদের ভয়াবহতা এবং সেই আইডিয়ার প্রতি ঘৃণা তৈরি করতে অনেকাংশেই সফল হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের (Office of the Historian) তৎকালীন নথি থেকে পাওয়া যায় সর্বমোট ১২টি প্রোগ্রাম হাতে নেয়, তারমধ্যে আবার আলাদা করে গ্রুপে ভাগ করেছিল। এর মধ্যে নাৎসি পার্টির তরলীকরণ প্রোগ্রাম, অ্যারেস্ট প্রোগ্রাম, চাকরি থেকে ছাঁটাই প্রোগ্রাম, নাৎসি আইন বাতিলকরণ, নাৎসি শিক্ষা ব্যবস্থা, নাৎসি মতবাদ ও সিম্বল বিলুপ্তীকরণ প্রোগ্রাম, নাৎসি সম্পদ আত্মীকরণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সোভিয়েতের পদ্ধতি ছিল কিছুটা আদর্শিক এবং বিপজ্জনকও বটে। প্রথম ধাক্কায় নাৎসি দলের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় ধাপে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়, সেই ক্যাম্পেই হাজার হাজার বন্দি মারা যায়। সোভিয়েতরা সেখানেই থেমে থাকেনি, পূর্ববর্তী উদার রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। তাদেরকে ফ্যাসিবাদের পূর্বসূরি স্টিগমাটাইজড করা হয়েছিল। অন্য তিন দেশের তুলনায় আরেকটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল নাৎসি পার্টির সাবেক সদস্যদের নিয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠন করা। সোভিয়েত রাশিয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিল নাৎসি মতবাদে আকৃষ্ট জনগণকে সমাজতন্ত্রের দিকে আকৃষ্ট করা।

এ চার দেশের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও নাৎসিবাদের জনপ্রিয়তা একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। বরং বিভিন্ন দেশে, অন্য কোনো ফর্মে সেটি ফিরে এসেছে। বর্তমানে জার্মানিতে গত এক দশকজুড়ে এএফডি (অল্টারনেটিভ ফর ডয়চল্যান্ড) নামক কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান ঘটেছে, যাদের নিওনাৎসি হিসেবে চিহ্নিত করছে পশ্চিমা মিডিয়াগুলি, তবে এবার টার্গেট ইহুদিরা নয় বরং আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসলিম অভিবাসী। ফানফ্যাক্ট হলো এ অতিমাত্রায় ডানপন্থী দলের প্রথম দিকের জনপ্রিয়তা পায় সাবেক পূর্ব জার্মানির অংশ থেকে, সোভিয়েতের পুনর্বাসন প্রকল্পে রাজনৈতিক দল খুলে রাজনীতি দেয়ার সিদ্ধান্তের সিলসিলা বলা যেতে পারে।

আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন মত দিতে দেখা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম আওয়ামী লীগের রাজনীতি সীমিত করার বিষয়ে মতামত দিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলাকালীন সংলাপে। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব বলেছেন আওয়ামী লীগ ভোটে এলে বিএনপির আপত্তি নেই। প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, বিএনপি চায় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। বিএনপি যেহেতু বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল, তাই তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য না করার কথাও স্বীকার করেন। এদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গত ৩১ ডিসেম্বরে আয়োজিত মার্চ ফর ইউনিটি প্রোগ্রামে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন।

নিষিদ্ধ দাবি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক থাকলেও যেটি অগোচরে ঘটছে তা হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন। দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন ভিন্নভাবে জামায়াত ও বিএনপি আওয়ামী লীগকে দলে টানার চেষ্টা চালাচ্ছে, কোথাও কোথাও পুলিশ আওয়ামী লীগের নেতাদের আইনি হেফাজতে নিলে তাদের ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে এ দুই দলের নেতাকর্মীরা (প্রথম আলো, ৬ জানুয়ারি ২০২৫)।

এ ঘটনাগুলো ডিনাজিফিকেশন প্রোগ্রামের মতো শুদ্ধি পরীক্ষা দিয়ে পুনর্বাসন না হলেও এক ধরনের পুনর্বাসন, তবে এ পুনর্বাসনগুলোর কোনো মানদণ্ড বা নির্দিষ্ট কোনো স্ট্র্যাটেজি নেই। ফলে পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ফৌজদারি অপরাধ করা নেতাকর্মীদের এক ধরনের দায়মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ডিনাজিফিকেশন প্রোগ্রামের কিছু ধাপে স্বল্প মেয়াদে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে জার্মানিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল, যার ফলে স্বল্প অপরাধী বা নিরপরাধ সাবেক নাৎসিরা সরকারি চাকরি ফিরে পায়, কেউ কেউ আগের পেশায় ফিরে যেতে পেরেছিল। এমনকি ১৯৬৬ সালে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর কুর্ট জর্জ কিসিঞ্জার যিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টির হয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন, তিনি সাবেক নাৎসি পার্টির সদস্য ছিলেন।

আওয়ামী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ওপরে উল্লিখিত পদ্ধতির কিছু অংশ বাংলাদেশে ব্যবহার করার উপযোগিতা আছে কিনা তা নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া সোভিয়েত রাশিয়ায় স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশ্চেভ ডিস্তালিনাইজেশন প্রোগ্রাম নিয়েছিল। অন্যদিকে স্পেনের একনায়ক ফ্রান্সিস ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর সে রকমই একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে ফ্রাঙ্কোর সিম্বল ধীরে ধীরে মুছে ফেলা হয়। এ পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার হয়তো বহু অমিল পাওয়া যাবে, আবার কোথাও কোথাও দেখা যাবে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাই ডি-আওয়ামীলীগাইজেশন প্রোগ্রামের ব্যাপারে রাষ্ট্র বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কী ধরনের চিন্তাভাবনা রয়েছে তা খোলাসা করা দরকার। না হলে দেখা যাবে যে একজন পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার কারণে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত এককালের আওয়ামী লীগ নেতা জামায়াত বা বিএনপির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিফিল্মের ভিলেনের মতো দেখা যাবে পরবর্তী এপিসোডে গল্পের মূল নায়ক বনে যাচ্ছে; রাজনীতির খেলায় সুপারম্যানের বেশ ধরে হোমল্যান্ডার হিসেবে পয়েন্ট কামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বেহাত বিপ্লবের শুরুটা হয় বেহাত পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে, তাই বিয়োজন বা পুনর্বাসন পরিকল্পনা মাফিক হওয়া উচিত।

মনজুরুল মাহমুদ ধ্রুব: গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

আরও