দুই অর্থবছরে বিভিন্ন খাতে শুল্ক অব্যাহতি ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা-বাণিজ্যকে সহজ করাসহ বিভিন্ন কারণে গত দুই অর্থবছরে শুল্ক খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা অব্যাহতি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে ৫১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অব্যাহতির পরিমাণ প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়ে হয় ৬১ হাজার ৩২ কোটি টাকা।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা-বাণিজ্যকে সহজ করাসহ বিভিন্ন কারণে গত দুই অর্থবছরে শুল্ক খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা অব্যাহতি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে ৫১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অব্যাহতির পরিমাণ প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়ে হয় ৬১ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। 

জানা গেছে, প্রজ্ঞাপন ও আদেশের মাধ্যমে শুল্ক অব্যাহতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে মূলধনি যন্ত্রপাতি, ত্রাণসামগ্রী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল, দেশে সেলফোন উৎপাদন, পোলট্রি শিল্প, ফ্রিজ ও এসি উৎপাদন, চাল আমদানি, টেক্সটাইল, অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা), ভোজ্যতেল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, অগ্রিম কর ও বিশেষ শুল্ক অব্যাহতি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুল্ক অব্যাহতির ৬১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এ খাতগুলোতেই ৪৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতগুলোয় অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ২৪৫ কেটি টাকা। 

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে শুল্ক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৪১ কোটি টাকা। এ খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে অব্যাহতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতেও অব্যাহতির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল ৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৯ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। পোলট্রি ফার্মেও গত অর্থবছরে শুল্ক অব্যাহতির পরিমাণ বাড়িয়েছে এনবিআর। এ খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৭০ কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৯৭৮ কোটি টাকা। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার শুল্ক সুবিধা দিলেও প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা এ থেকে বঞ্চিত। মূলত সব সুবিধা নিচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার তারাই ভোক্তাদের পকেট কাটছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে করপোরেট খামারিদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়া উচিত। পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের কীভাবে সুরক্ষা দেয়া যায় সেটা ভাবা এখন জরুরি। তাদের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য সরকারকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করি।’

স্ট্যাটিউটরি রেগুলেটরি অর্ডার (এসআরও) জারির মাধ্যমে টেক্সটাইলে গত অর্থবছরে শুল্ক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ৯৫৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৭২৯ কোটি টাকা। এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে প্রতি অর্থবছরই বিশেষ শুল্ক সুবিধা দেয় সরকার। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেজার অব্যাহতির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬৬৩ কোটি টাকা। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানিতেও শুল্ক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ৮২৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৫৮ কোটি টাকা অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ভোজ্যতেলেও শুল্ক অব্যাহতির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে যা ছিল ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। 

এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষকে সুবিধা দিতেই সরকার শুল্ক অব্যাহতি দেয়। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সয়াবিন তেলে এ সুবিধা দিয়েছে সরকার। ফলে জনগণ কম দামে সয়াবিন তেল পেয়েছে। যখন এ সুবিধা তুলে নেয়া হলো তখন তেলের দাম বেড়ে গেল।’ 

রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানিতে অবশ্য শুল্ক অব্যাহতির পরিমাণ কমানো হয়েছে। গত অর্থবছরে এ খাতে অব্যাহতির পরিমাণ ১ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা হলেও আগের অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। দেশে সেলফোন উৎপাদনের জন্য বিদেশ থেকে আনা যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রেও শুল্ক অব্যাহতির পরিমাণ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৬ কোটি টাকা ছাড় পেলেও গত অর্থবছরে ২ হাজার ২৪১ কোটি টাকা শুল্ক দিতে হয়েছে এ খাতের ব্যবসায়ীদের। এছাড়া বিশেষ অব্যাহতি, ত্রাণসামগ্রীসহ আরো কয়েকটি খাতেও শুল্ক অব্যাহতি কমানো হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লিমিটেড অ্যাসেনশিয়াল পণ্যের ওপর শুল্ক অব্যাহতি দেয়ার জন্য সরকার চেষ্টা করেছে। তবে আইএমফের প্রোগ্রামে ছিল যে সরকার অব্যাহতির পরিমাণ কমিয়ে কিছু টাকা বাঁচাবে। এসব বিষয়ে সরকার কী করেছে বা কোন কোন ক্ষেত্রে করেছে তা আমরা পরিষ্কার না।’

সরকার এনবিআরের মাধ্যমে গত অর্থবছরে মোট ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়েছিল। এর মধ্যে আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক হিসেবে আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছর শেষে এ খাতে আহরণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যের তুলনায় ১৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ঘাটতি থেকে গেছে। বিভিন্ন খাতে শুল্ক অব্যাহতির কারণেই এ ঘাটতি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। 

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুল্ক অব্যাহতি যে কারণে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ কোনো একটা জিনিসের দাম কমানোর জন্য। এখন বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে যে আসলেই সে পণ্যের দাম কমেছে কিনা। শুল্ক অব্যাহতি দেয়ার পর আমদানিকারক যদি বাজারে দাম না কমায় তাহলে সেটা আপত্তিকর।’ 

আরও