সামনের দিনগুলোয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। বাংলাদেশের নামও এ তালিকায় রয়েছে। এফএও মনে করছে, বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরো নাজুক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া। রোহিঙ্গা সংকট এ চাপকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।
এফএওর চলতি মাসে প্রকাশিত ‘ক্রপ প্রসপেক্টস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন’ শীর্ষক ত্রৈবার্ষিক প্রতিবেদনে এ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। এর সঙ্গে একমত পোষণ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে তা সমাজে শ্রেণীগত অবনমন নিয়ে আসে। নিম্ন আয়ের মানুষ পরিণত হয় দরিদ্রে। সর্বশেষ করোনার সময়ও এমন দেখা গিয়েছিল। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বড় অবনমন ঘটাচ্ছে। আবার অর্থ সংকটের কারণে সরকারের পক্ষেও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তাই চ্যালেঞ্জে পড়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার দুই অংকের ঘরে থাকায় প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বড় অবনমন ঘটেছে উল্লেখ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের মানুষের বড় একটি অংশ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়ে গেছে। সরকার ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে বা খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করলেও তা সবার জন্য যথেষ্ট নয়। আবার অর্থ সংকটে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সম্প্রসারণের পথেও হাঁটতে পারছে না সরকার। চাহিদা, আমদানি ও উৎপাদনের তথ্য-উপাত্তের মধ্যেও বিভ্রাট রয়েছে। ফলে সঠিক নীতি গ্রহণ করা যাচ্ছে না। সরকারকে এখন বাজার ব্যবস্থাপনার দিকেও জোরালোভাবে নজর দিতে হবে।’
দেশের অর্থনীতিতে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আশঙ্কা তৈরি করছে রিজার্ভ তথা ডলার সংকট এবং টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন। আমদানি নিয়ন্ত্রণ প্রভাব ফেলছে শিল্প উৎপাদনে। কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করতে বেগ পেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ডলারের অভাবে ব্যাংকগুলোয় সময় ও প্রয়োজনমতো এলসি খুলতে পারছেন না তারা। একই সময়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগেও। এ দুই বছরে রিজার্ভের ক্ষয় থামাতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়েছে। মুদ্রাটির বিনিময় ৮৪ থেকে বেড়ে এখন ১১৮ টাকা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এছাড়া দুই বছর ধরে দেশের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে। এ সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা গত এক যুগে সর্বোচ্চ।
এসব অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি দেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাকে আরো নাজুক করে তুলছে বলে এফএওর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে আরো উঠে আসে, এ সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলছে আবহাওয়ার বিরূপ তথা চরমভাবাপন্ন আচরণ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তাকে আরো চাপে ফেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গড়ে দেশের ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশের অতিদরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে এ হার ২২ দশমিক ৯ শতাংশ আর মধ্যবিত্তদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকে দেশ বিরাট শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সাবেক খাদ্য সচিব মো. আবদুল লতিফ মন্ডল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন কমায় গমের চাহিদার ৮৫ শতাংশ আমাদের আমদানি করতে হয়। কিন্তু বৈশ্বিক উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরবরাহ জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম ফের বাড়লে চালের ওপর চাপ বাড়বে। আবার মূল্যস্ফীতির তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না। ফলে দারিদ্র্যসীমায় থাকা ৩ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আর দীর্ঘ সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলে সমাজে শ্রেণীগত পরিবর্তন হয়। নিম্ন আয়ের মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। করোনার সময় এমনটা ঘটেছিল।’
দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য গমের আমদানিনির্ভরতা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সদ্য বিদায় নেয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে গম আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৮ লাখ ৭ হাজার টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানি করা হয় প্রায় ৭ লাখ ৮৩ হাজার টন। আর বেসরকারি খাতে আমদানি করা হয় ৬০ লাখ ২৪ হাজার টন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর গম আমদানি হয়েছিল ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টন। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছর গম আমদানি বেড়েছে প্রায় ২৯ লাখ ৩৩ হাজার টন। গম আমদানি প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গম আমদানির রেকর্ড হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ড. শামসুল আলম সম্প্রতি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। গত বছর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতিও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। আর খাদ্যে মানুষ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করে থাকে। তাই মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়তে পারে। তবে গত ১৫ বছরে বেতনও বাড়ানো হয়েছে। ফলে কর্মজীবীদের ব্যাংকে জমাও বেড়েছে। যাদের মজুরি কম, তাদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেশি হতে পারে।’