দেশে সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়লেও সে অনুযায়ী বাড়েনি কাস্টমস ও বন্দর সুবিধা। আমদানি পণ্যের আগামপত্র দাখিল থেকে খালাস করা পর্যন্ত কাস্টম হাউজেরই সময় লাগে গড়ে প্রায় দুই সপ্তাহ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীদের ফাস্ট ট্র্যাক সুবিধার মাধ্যমে পণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর বা এইও সুবিধা বাস্তবায়ন করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যদিও আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে অতীত রেকর্ডসহ বেশকিছু বিবেচনায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই এ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি।
জানা গিয়েছে, এইও বা ট্রাস্টেড ট্রেডার্স হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে গত এপ্রিল থেকে আবেদন চেয়েছে এনবিআর। এ স্বীকৃতি পেতে ৬১ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। এর মধ্যে দেশের উত্পাদন ও সেবা খাতে নেতৃত্ব দেয়া প্রায় সব কোম্পানি রয়েছে। যদিও নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে পেরেছে এমন মাত্র ১০ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে যোগ্য বলে মনে করছে এনবিআর। এর আগে ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে তিনটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে এইও সুবিধা প্রদান করলেও নির্ধারিত ভ্যাট সফটওয়্যার ইনস্টল না করায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কয়ার ফার্মা ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস এ সুবিধার পুরোপুরি বাস্তবায়নে যেতে পারেনি।
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এইও সুবিধা বিস্তৃত করে বন্দর থেকে কারখানা পর্যন্ত সরবরাহ ব্যবস্থায় গতি জোরালো করতে চায় এনবিআর। কিন্তু এজন্য প্রতিষ্ঠানের অতীত রেকর্ড পর্যালোচনা করতে গেলেই দেশের নামকরা বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ বেশির ভাগই অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আমদানি-রফতানির হিস্ট্রি পরিচ্ছন্ন না হলে এ সুবিধা দেয়াটা অনেক বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। প্রাথমিকভাবে মাত্র ১০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে যোগ্য বিবেচনায় আনা হলেও চূড়ান্তভাবে তালিকাটি আরো ছোট হয়ে আসবে।
এইও হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে কাস্টম হাউজ বা স্টেশনের পরিবর্তে নিজ প্রতিষ্ঠানের কারখানা প্রাঙ্গণে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা করানোর সুযোগ পাবেন। পণ্যের সরাসরি খালাস বা জাহাজীকরণের সুযোগ মিলবে। পণ্যের চালান বন্দরে আসার আগেই বিল অব এন্ট্রি বা বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করে শুল্কায়ন কাজ এগিয়ে নিতে পারবে এইও। এমনকি দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ টিম গঠনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে এ সুবিধায়।
তবে এ সুবিধা পেতে কিছু যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছে এনবিআর। ধারাবাহিকভাবে দেশে পাঁচ বছর ব্যবসা পরিচালনা করছেন এমন আবেদনকারী ব্যবসায়ী বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আবেদনের সময় থেকে গত তিন বছরের প্রমাণিত অপরাধমুক্ত থাকতে হবে। স্যাটিসফ্যাক্টরি কমপ্লায়েন্স রেকর্ডধারী প্রতিষ্ঠানের আবেদনের সময় পর্যন্ত নিরঙ্কুশ রাজস্ব পরিশোধের রেকর্ড থাকতে হবে। ধারাবাহিকভাবে আবেদনের তারিখ থেকে বিগত তিন বছরে শুল্ক মূসক এবং আয়কর-সংক্রান্ত কোনো মামলায় (আদালতে বিচারাধীন মামলা ব্যতীত) জরিমানার পরিমাণ মোট পণ্য মূল্যের ১ শতাংশের বেশি হওয়া যাবে না। এছাড়া আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন ১৫ কোটি এবং পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ৫ কোটি টাকা, আর আমদানির পরিমাণ হতে হবে বছরে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা।
এনবিআরের এইও-সংক্রান্ত কার্যক্রম দেখভাল করছে বাংলাদেশ শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট। সংস্থাটির কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী খুঁজে এইও সুবিধা বিস্তৃত করতে চাই। এর মধ্যে যে আবেদন পেয়েছি, সেগুলো যাচাই করতে হয়েছে। কারণ যেনতেনভাবে এ সুবিধা প্রদানের সুযোগ নেই। এখানে রাজস্ব সুরক্ষার বিষয়টি জড়িত। রাজস্ব সুরক্ষায় যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো খুব অল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া এইও বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভ্যাট সফটওয়্যার থাকার শর্ত রয়েছে। এ সফটওয়্যার যুক্ত না করায় এর আগে সুবিধা দেয়া তিন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করা সম্ভব হয়নি। প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে শুধু আমদানিকারকের খরচ ও সময়ই কমাবে না, বরং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার ক্ষেত্রে বড় একটি ভূমিকা রাখবে।’
এনবিআরের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, দেশের সব শুল্ক স্টেশন মিলিয়ে গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। আর রফতানি আয় হয়েছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। এ সময়ে আমদানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানই রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, সিটি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, বিএসআরএম ও বসুন্ধরা গ্রুপ। গত ১০ বছরে এসব শিল্প গ্রুপ দেশে ব্যবসার বড় ধরনের প্রসার ঘটিয়েছে।
ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা বৈদেশিক বাণিজ্যে নির্ভর করেন মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে (বাণিজ্যিক খাতে) ৪ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৯ কোটি ২৩ লাখ টন পণ্য খালাস হয়েছে। এ আমদানিতে সক্রিয় ছিল ১৯ হাজার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে এর মধ্যে ২৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো এককভাবে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি আমদানি করেছে। এক্ষেত্রে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শুধু সেসব সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, যেগুলোর আমদানি ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেসরকারি খাতে হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানির এ তালিকাটিতেও রয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বিএসআরএম, সিটি গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপসহ টিকে গ্রুপ, কেএসআরএম, আকিজ গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, জিপিএইচ গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, ট্রান্সকম, প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড, এসএস পাওয়ার লিমিটেড, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওয়ালটন, কনফিডেন্স গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, এ এ ইয়ার্ন মিলস, ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ার ও বিইওএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এতে বিদেশী কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ইউনিলিভার, রেনাটা লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, আরপিসিএল-নরিনকো ও রিলায়েন্স বাংলাদেশ এলএনজি অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা মেটাতে বড় ভূমিকা রাখছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। ফলে তাদের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও নির্বিঘ্ন হওয়া জরুরি। এতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেড়ে শিল্পের পরিসরও বাড়বে। এইও এমন একটি সুবিধা এনবিআর প্রতিষ্ঠান করতে চাইছে যেটি প্রসারিত করতে পারলে দেশের পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন আসবে।’