ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতি

সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ভোট ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আগামী রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে আগামী রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ড. ইউনূস বলেছেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে রমজান শুরুর আগের সপ্তাহেও অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। লন্ডনে গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে এক যৌথ বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এর আগে গত ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এ ঘোষণার পরপরই শুরু হয় বিতর্ক। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের যে দাবি তাতেই অনড় থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গনে চলতে থাকে ডিসেম্বর-এপ্রিলের দ্বৈরথ। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বৈঠকে বসেন যুক্তরাজ্য সফররত ড. ইউনূস। লন্ডনের পার্ক লেনে হোটেল ডোরচেস্টারে স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা ২টায়) এ বৈঠক শুরু হয়, চলে প্রায় দেড় ঘণ্টা।

বৈঠকে আগামী রমজানের আগে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। তার জন্য ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি‌ অর্জনের প্রয়োজন হবে। তারেক রহমান তখন প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে স্বাগত জানান বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

পরে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসেন অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির উপস্থিত ছিলেন।

আলোচনার বিষয়ে যৌথ ঘোষণা পড়ে শোনান খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, এ বৈঠকে নির্বাচনের তারিখসহ নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সব ধরনের বিষয় আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনী রোডম্যাপ বা ভোটের তারিখ ঘোষণার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।

অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা তখন বলেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।

খলিলুর রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এ অবস্থানকে তারেক রহমান স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টাও ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য তারেক রহমানকে ধন্যবাদ জানান।

ভোটের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন শিগগির তারিখ ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আজকে যৌথ বিবৃতিতে বলে দিয়েছি দুপক্ষই। নির্বাচন কমিশন (ইসি) আশা করি শিগগির একটা তারিখ ঘোষণা করবে।

এপ্রিলের বদলে নির্বাচন এগিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় এ ঘোষণায় আপনারা সন্তুষ্ট কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে বৈঠক নিয়ে খলিলুর রহমান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট’।

আমীর খসরু বলেন, আমরা তো বলছি, নির্বাচনের আগে নয় শুধু, নির্বাচনের পরও দেশ গড়ার কাজে সবাই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ সময় খলিলুর বলেন, সন্তুষ্ট না হলে যৌথ ঘোষণায় আসার কথা নয় আমাদের।

যৌথ ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু বলেন, সংস্কার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, আমরা সবাই একই কথা বলছি। যে বিষয়গুলোয় ঐকমত্য হবে, সেগুলোই সংস্কার হবে। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। এমন নয় যে সব সংস্কার এখনই হয়ে যাবে। নির্বাচনের আগেও সংস্কার হবে, যেখানে ঐকমত্য হবে; নির্বাচনের পরও সংস্কার অব্যাহত থাকবে। দেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়েছি, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করছে। সুতরাং আগে-পরে সংস্কার চলতে থাকবে।

তারেক রহমান কবে ফিরবেন, এ বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চান এক সাংবাদিক। এ সময় আমীর খসরু বলেন, এ ব্যাপারে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। তারেক রহমানের যখন ইচ্ছা দেশে ফিরে যেতে পারবেন, সুতরাং সিদ্ধান্ত উনি নেবেন সময়মতো।

আরেক প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, যৌথ বিবৃতিতে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে। আমরা আত্মবিশ্বাসী। এ অগ্রগতি নির্বাচনের আগে দেখতে পাব।

এ সময় একজন সাংবাদিক বলেন, ইসি পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে আসা জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) বলেছে, ইসির সংস্কার ছাড়া তারা ভোটে যাবে না। জবাবে আমীর খসরু বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখানে কোনো আলোচনার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’

প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত থাকার কথা তুলে ধরে নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সবাইকে নিয়ে নির্বাচনটা করতে চাচ্ছি।’

এদিকে বৈঠক শুরুর আগে কুশল বিনিময়ের সময় তারেক রহমান তার মা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘সালাম’ পৌঁছে দেন ড. ইউনূসের কাছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির এবং প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম। পরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের একান্ত বৈঠক হয়। এর আগে বাংলাদেশ সময় ১টা ৫০ মিনিটে গাড়িযোগে হোটেলে পৌঁছান তারেক রহমান। সেখানে তাকে স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে আমীর খসরু বলেন, ‘বৈঠকের আগে প্রতিনিধিসহ আলোচনা হয়েছে। পরে ওনারা একান্তে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করেন।’

লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের পর বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল সে অবস্থাকে কাটিয়ে, জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা। তারা প্রমাণ করলেন যে বাংলাদেশের মানুষ এখনো প্রয়োজনের সময় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, নেতারা নেতৃত্ব দিতে পারে।’

দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে তারেক রহমানকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান বিএনপি মহাসচিব। এ বৈঠকের ফলাফল জানতে গোটা জাতি উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করেছিল উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বৈঠকে যে বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে প্রধান ছিল নির্বাচন ইস্যু। সে নির্বাচন ইস্যুতে তারেক রহমানের যে প্রস্তাব, গোটা জাতি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করল যে এটায় প্রধান উপদেষ্টা সম্মত হয়েছেন এবং তারা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন।’

এ বৈঠক সত্যিকার অর্থে একটি ‘টার্নিং পয়েন্টে’ পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এখন প্রয়োজন অতীতের কথা ভুলে গিয়ে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা। বিগত ১৫ বছরে “ফ্যাসিস্টদের” করা ধ্বংসস্তূপকে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রূপান্তরিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে চলেছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গণতন্ত্র কিন্তু একটা দিনের ব্যাপার নয়। গণতন্ত্র হচ্ছে একটা চর্চার বিষয়। এটা একটা কালচার (সংস্কৃতি)। এ কালচারটা আমাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে।’

আরও