জলবায়ু পরিবর্তন

অক্টোবর ও নভেম্বরে ডেঙ্গু আরো মারাত্মক হতে পারে?

দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তিন মাস ধরে রোগী ও মৃতের সংখ্যা ‍বৃদ্ধিতে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের এ সময়ে এসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগটির প্রাদুর্ভাবে বৈচিত্র্য দেখা গেছে। মূলত বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এ রোগ আগামী অক্টোবর ও

দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তিন মাস ধরে রোগী ও মৃতের সংখ্যা ‍বৃদ্ধিতে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের এ সময়ে এসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগটির প্রাদুর্ভাবে বৈচিত্র্য দেখা গেছে। মূলত বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এ রোগ আগামী অক্টোবর ও নভেম্বরে আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। গত বছরে ওই দুই মাসে হাসপাতালে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তি হতে দেখা গেছে। সে বছরেও বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। একই ধারার বৃষ্টিপাতের কারণে চলতি বছরের শেষ প্রান্তিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রোগতত্ত্ববিদরা।

তারা বলছেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব ব্যবস্থাপনা কঠিন। কেননা সারা বছর উষ্ণ তাপমাত্রা মশার প্রজনন ও ভাইরাসের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী হয়ে কাজ করে। বড় আকারের ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ, মশার ঘনত্ব কমাতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন না করা এখন ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর বিদ্যমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাস্থ্য খাতে অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করছে। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর মারা গেছে প্রায় ১৩০০ রোগী।

সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বলছে, দেশে প্রথম ২০০০ সালে ডেঙ্গু রোগতত্ত্বের গুরুত্ব পায়। সে বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় ও মারা যায় ৯৩ জন। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু। সে সময় ডেঙ্গুকে ঢাকা ফিভার নামে অভিহিত করা হয়। ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে মারা যায় ২৮১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক অর্থাৎ এক লাখের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। আর চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৯৫ হাজার ৮৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে ৪৫৩ জন। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডেঙ্গুবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল উইলিতে ‘রিসেন্ট আউটব্রেক অব ডেঙ্গু ইন বাংলাদেশ: আ থ্রেট ট্রু পাবলিক হেলথ’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রকাশ পায়। এতে বলা হয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে। দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এ চিত্র দেখা যায়। গত বছর দেশে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক ছিল না। বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের ফলে অক্টোবর ও নভেম্বরে রোগী বেশি ছিল। গত বছর মোট হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর ৩৫ শতাংশ অক্টোবর ও ৩১ শতাংশ নভেম্বরে। নভেম্বরে অক্টোবরের চেয়ে কম রোগী থাকলেও নভেম্বরে মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি। 

দেশের ডেঙ্গুবিষয়ক হালনাগাদকৃত সর্বশেষ তথ্যে গতকাল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, আগস্টের প্রথম ১৭ দিনেই দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৪৫ জনে। এত রোগী এ বছর আর কোনো মাসে দেখা যায়নি। এর আগে জুলাইয়ের ৩১ দিনে ৪৩ হাজার ৮৫৪ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। রোগটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫৩-এ।

এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। জানুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ১ হাজার ৩৬ এবং জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। চলতি আগস্টের প্রথম ১৭ দিনে ডেঙ্গুতে ২০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের মাস জুলাইয়ে সর্বাধিক ২০৪ জনের মৃত্যু হয়। জানুয়ারিতে মৃতের সংখ্যা ছিল ছয়, ফেব্রুয়ারিতে তিন, এপ্রিলে দুই, মে মাসে দুই এবং জুনে ৩৪।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ, মানুষের গতিশীলতা বৃদ্ধি, অনুপযুক্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নিরক্ষরতা ও সচেতনতার অভাবের মতো বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণে বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সুস্থতার ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ নিম্নভূমির দেশগুলো খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। এ শতাব্দীতে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বাড়তে পেতে পারে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুজ্বর, কালাজ্বর এবং জাপানিজ এনসেফালাইটিস ভাইরাস সংক্রমণের মতো ভেক্টরবাহিত রোগের পরিধি বাড়তে পারে। আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে রোগ সৃষ্টিকারী জীবের বণ্টন পরিবর্তন হতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত দেশে জুলাইয়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। তবে গত বছর ও চলতি বছরে ওই মাসে স্বাভাবিকের অর্ধেক বৃষ্টিও হয়নি। গত ৩৫ বছরের ইতিহাসে জুলাইয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে ২০২২ সালে। কয়েক বছর ধরে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির ধরনও পাল্টে যাচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৫২৩ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। আর প্রায় ৪৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় জুনে। আগস্টে এসে এ পরিমাণ ৪২০ মিলিমিটারে নামে। তবে গত বছরের জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ ও চলতি বছরে গড় বৃষ্টিপাত ৫১ শতাংশ কম হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি বছরে জুনে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুলাইয়ে কম হয়েছে ৫১ শতাংশ। তবে আগস্টের শুরু থেকেই বৃষ্টি অনেক বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ শতাংশের বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এর পরও বৃষ্টিপাতের হার বেশি থাকবে। আবহাওয়ার এমন বিরূপ আচরণ মূলত গত বছর থেকেই শুরু হয়েছে। এল নিনোর প্রভাবে আবহাওয়া এমন আচরণ করছে। এটা আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত থাকতে পারে। অর্থাৎ বৃষ্টি হলে অনেক বেশি হবে। আবার খরা থাকলে বেশি খরা থাকবে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্থানে দাবানলে ক্ষতি হচ্ছে। ভারতে অনেক জায়গায় অস্বাভাবিক বন্যা হচ্ছে। আবার অনেক স্থানে খরা দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ বিশ্বব্যাপীই দেখা যাচ্ছে।’

তাপ ও আর্দ্রতার সঙ্গে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আপেক্ষিক তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ ও সূর্যের আলোর তীব্রতা এডিস মশার প্রজননের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এডিস মশার বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এডিসের প্রজননক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পানি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। বৃষ্টিপাত বাড়লে বা অসময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হলে এডিস মশার ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে। এতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়বে। গত বছর বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিক অবস্থার কারণে অক্টোবর ও নভেম্বরে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পেয়েছিল।’

বাংলাদেশে আবহাওয়াজনিত পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগের বৃদ্ধি স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংক্রামক রোগের বৃদ্ধিবিষয়ক এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, একটি দীর্ঘ উপকূলরেখা এবং প্লাবনভূমি যা দেশের ৮০ শতাংশ নিচু, নদী ও বদ্বীপ হওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন শুধু ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা নয়। পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার ধরন মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করছে। দেশে ১৯৭৬ সাল থেকে বছরে গড়ে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ সারা দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার বৃদ্ধি একই রকম হয়নি। সাধারণভাবে গ্রীষ্মকাল দীর্ঘতর হচ্ছে ও শীতকাল উষ্ণ হচ্ছে এবং বর্ষা অস্বাভাবিক হচ্ছে।

গত বছরের মতো এ বছর বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়া পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অক্টোবর ও নভেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এ বছর নভেম্বরে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। বৃষ্টিপাতের কারণে এডিস মশা বৃদ্ধি পাবে। এতে ডেঙ্গু রোগী বাড়বে। মৃত্যুও বাড়তে পারে। আমাদের এ দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানাবিধ সমস্যা হয়। তবে আমাদের দেশের মতো জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে হয়নি। তার কারণ হচ্ছে এসব সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে মানবসৃষ্ট অব্যবস্থাপনা এবং পরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু মারাত্মক হচ্ছে।’

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে সমন্বিত কাজ করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। তিনি জানান, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া রয়েছে। চিকিৎসা প্রদান সক্ষমতার বাইরে যায়নি।

আরও