খেয়াল-খুশি শব্দবন্ধ আমাদের বেশ পরিচিত। ইচ্ছামতো কোনো কিছু করাকেই খেয়াল-খুশি বলে। আবার কেবল ‘খেয়াল’ বলতে বোঝায় আনমনে থাকতে কোনো কিছু করা। তবে খেয়ালের আরেকটা মানে আছে। এটি একধরনের উচ্চাঙ্গসংগীত। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, উচ্চাঙ্গসংগীতের দ্বিতীয় শাখা। ধ্রুপদের মতো এটি কঠোর নিয়মে আবদ্ধ না। অলংকার প্রয়োগ ও তানবিস্তার করা যায়। শুনলে মনে হয় কল্পনার জগতের কাছে যাচ্ছেন শ্রোতা। মুনেম ওয়াসিফের ‘ক্রমশ’ নিয়ে আলাপের শুরুতে ‘খেয়াল’ চলে আসে। কেননা এ প্রদর্শনীর একটি পর্ব খেয়াল। ২৩ মিনিটের বেশি দৈর্ঘ্যের এ চলচ্চিত্র দেখে উচ্চাঙ্গসংগীতের খেয়ালের কথাই খেয়ালে আসে। কেননা শব্দ আর চিত্রের মাধ্যমে মুনেম সম্ভবত দর্শককে তার খেয়ালের জগতেই নিতে চেয়েছেন।
পুরান ঢাকার অলিগলির পাশে আসে এক বৃদ্ধ। তার গালভরা এলোমেলো দাড়ি, মুখের রেখায় প্রাচীনত্ব। সরু গলির ছাপ তার মুখে। তার বাড়ির দেয়ালেও। কয়েকটা রেখা পড়া দেয়াল, দেয়ালে ফ্রেমে রাখা ছবির সঙ্গে হারমোনিয়ামে সুর উঠলে দর্শক নিশ্চিত পুরান ঢাকার পৌরাণিক সত্তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করবেন। দুই দালানের মধ্য থেকে দেখা আকাশ, দেয়ালে জন্মানো গাছ, পাখির উড়ে যাওয়া আলাদা সংগীত তৈরি করে। নির্বাক এ চলচ্চিত্র একটা সময় আমাদের বোঝায়, কেবল শব্দ বা দৃশ্য নয়, ঘ্রাণের সঙ্গেও এর যোগসূত্র আছে। বিশেষত, প্রধান চরিত্রটি যখন এক নারীর চুলের সুবাস নেয়, সে সময় দর্শক নিজেদের খুঁজে পাবেন যাপিত জীবন ও চলার পথে নিজেদের টেনে ধরা নানা ঘ্রাণের মধ্যে।
বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলমান ‘ক্রমশ’ দেখতে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে সাদাকালো তিনটি ছবি। প্রথম ছবিটি নারী-পুরুষের হাসিমুখের। উদযাপন সেখানে স্পষ্ট। ভাঙা বাড়ির ইট বেরোনো দেয়ালের সামনে তাদের উদ্ভাসিত মুখ জীবন উদযাপনের কথা মনে করায়। দ্বিতীয় ছবিতে একটি লোক কুয়োতলায় বসে বাসন মাজছে। তার চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কাক। বসে আছে কাক ও একটি বিড়াল। স্থানটি বিউটি বোর্ডিং? হতেও পারে। এ ছবিতে কেন জানি না ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে পড়ল এডগার অ্যালান পোকে। তৃতীয় ছবিও এক রকম উদযাপনের। কয়েকটি ছেলে কোনো এক আমোদে হাসছে তাদেরই একজনকে ধরে।
মুনেম ওয়াসিফের এ প্রদর্শনীতে তিনি সময়কে তুলে রেখেছেন ফ্রেমে ও তার কাজে। খানিকটা এগোলেই একটা অংশে টেবিলে রাখা ২৭টি পেপার নেগেটিভ। লোহার পা, পুরনো তক্তা, পেরেকের সঙ্গে এ ২৭টি নেগেটিভ মনে করিয়ে দেয় ক্যামেরা ও ছবি তোলার অতীতের কথা। তখনো ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা হতো না। নেগেটিভ ডেভেলপ করে ছবি ধোয়া হতো। ক্রমশ থেকে জানা যায়, ঢাকায় কয়েক দশক আগেও ছিল বক্স ক্যামেরা। তিন পায়ার ওপর বসিয়ে তোলা ছবি মিনিটেই তৈরি হতো বলে একে মিনিট ক্যামেরাও বলা হতো। মুনেম ওয়াসিফ ২০১৩-১৫ সাল অবধি ফটোগ্রাফার শেখ মোহাম্মদ সফদার হোসেনের সহযোগিতায় বক্স ক্যামেরা দিয়ে পুরান ঢাকায় ছবি তুলেছেন। ২৭টি নেগেটিভে ভিন্ন মানুষের মুখ আছে। তবে তা বোঝা যায় না। এর সামনেই চলমান চিত্রও নেগেটিভ স্টাইলে দৌড়াচ্ছে।
একটা দীর্ঘ সময় কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা বিষয়ের ছবি তোলা হলে তার ইতিহাসটাও সেখানে লিপিবদ্ধ হয়। মুনেম ওয়াসিফের চিত্রকর্মেও সেই ছাপ দেখা যায়। পুরান ঢাকার সঙ্গে তার সম্পর্কটা আত্মিক। তার ফটোগ্রাফির সূচনা হয়েছিল পুরান ঢাকার রাস্তাঘাটে। অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছেন, দেখেছেন। সেই ছবিগুলো যখন পরপর বসে তখন স্থানের ইতিহাসটা বোঝা যায়। যেমন শুরুর সাদাকালো ছবি পেরিয়ে এলে আরেক দেয়ালে ইট বেরোনো দেয়ালের সাদাকালো ছবির পাশে দেখা যায় রঙিন ছবি। যদিও সেখানে পুরনো আমলের বেড সুইচ, চল্টা ওঠা রঙের দেয়াল দেখা মেলে। তবে সেই সঙ্গে পাশেই থাকে রঙিন সাউন্ডবক্স, তারও পাশে, গ্লাসে ঠেকনা দেয়া মোবাইলে ক্যাটরিনা কাইফের ছবি সম্ভবত বদলে যাওয়া সময়েরই কথা বলে।
দীর্ঘ সময়ে ফটোগ্রাফি, স্থানকে ধরে রাখার এই যাত্রায় পুরাণ ঢাকা ও নিজের শিল্প-ভাষার পরিবর্তন নিয়ে মুনেম ওয়াসিফ বলেন, ‘গত দুই দশকে শুধু পুরান ঢাকা নয়, পুরো ঢাকা শহরের বেশিরভাগ জায়গাই বিশেষ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমিও শিল্পী এবং মানুষ হিসেবে অনেক পরিবর্তন হয়েছি। শিল্পী হিসেবে আমার দেখার চোখ, আমার বলার ভাষা, অথবা আমি যেভাবে কোনো কিছু অনুভব করি তারও অনেক কিছু পাল্টে গেছে।
আমার প্রথম জীবনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শহীদুল জহিরের সাহিত্য দ্বারা বেশ অনুপ্রাণিত ছিলাম। ইলিয়াসের ছোট গল্পের ভাষার যে বুনন অথবা পুরান ঢাকাকে বিস্তারিত সুন্দরভাবে দেখার যে অভিপ্রায় আছে, সেটা আমার ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ছবিতে তার প্রভাব আছে।
এছাড়া শহীদুল জহিরের গল্পের মধ্যে একটা ঘোর আছে। যার মধ্যে একটা পুনরাবৃত্তির গল্প আছে। সেটার প্রভাব আমার ফিল্ম ‘খেয়াল’-এর মধ্যে দেখতে পাবেন। আমার পরের দিকের রঙিন ছবিগুলোতে আবার একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
এ ছবিগুলোতে এলইডি লাইট দেখতে পাচ্ছেন। হয়তো একটা গ্লোভ দেখতে পাচ্ছেন। ডিজিটাল ঘড়ি দেখতে পাচ্ছেন, বা নাগরিক নানা কাঠামো দেখতে পাচ্ছেন। সর্বোপরি রঙ দেখতে পাচ্ছেন। হয়ত পুরনো একটা বাড়ি স্থাপত্যের পরিবর্তে নতুন একটা একটা মেটালের এসএস-এর গেইট দেখতে পাচ্ছেন। ফলে এক দিকে যেমন পুরনো ঢাকার ভিতরে বিশ্বায়ন, নাগরিক কাঠামোর পরিবর্তন এসেছে, আবার শিল্পী হিসেবে আমার দেখার চোখেরও পরিবর্তন এসেছে। আগে আমি হয়ত পাবলিক প্লেসে অনেক কিছু ঘটছে এমন একটা থিয়েট্রিক্যাল নাটকীয় মুহূর্ত ধরার চেষ্টা করছি। পরের দিকের কাজ আবার অনেক বেশি স্থির, গোছানো এবং এক ধরনের ম্যাক্রো জুম ইন করে আমি একটা নির্জীব বস্তুর ভিতর দিয়ে একটা এলাকার কিংবা পরিবারের কিংবা একজন ব্যক্তির গল্প কিংবা ছোঁয়া দেখতে চাচ্ছি। ফলে পরিবর্তনটা বহুমাত্রিক। আমি আমার কাজটাতে এক ধরণের গল্প না বলে নানা ধরণের পরিবর্তনের উপস্থিতির আভাস দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
ক্রমশর কিউরেটরিয়াল উপদেষ্টা তানজিম ওয়াহাবের মতও এ প্রকার। মুনেম ওয়াসিফের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সমাহার এ আলোকচিত্রগুলো। কিন্তু তা প্রচলিত অর্থে কোনো খেরোখাতা না। তবে ছবিগুলো অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে বিস্তৃত নানা মুহূর্তের সমাহার। এর মধ্যে কিছু রেকর্ড করা, কিছু আয়োজন করে তোলা আর কিছু সম্পূর্ণ কল্পনার খোরাক।
কল্পনার বিষয়টি আবারো যুক্ত হয় খেয়ালের সঙ্গে। ২০১৫-১৬ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রদত্ত সুবীর চৌধুরী প্র্যাকটিস গ্র্যান্টের সুবাদে এটি নির্মাণ শুরু করেছিলেন শিল্পী। প্রায় চার বছর ধরে এটির কাজ করেছেন মুনেম ওয়াসিফ। এটিকে তিনি বাস্তব ও কল্পনার মেলবন্ধন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মানুষের অন্তর্গত খেয়ালে গিয়ে নাড়া দেয় এটি।
প্রদর্শনীর আরেকটি সেগমেন্ট ‘স্টেরিও’। দুই দশক ধরে ভাঙা-গড়ার যে পরিক্রমা দেখেছেন মুনেম ওয়াসিফ, তারই উপস্থাপন এটি বা বলা যায় শিল্পচর্চার ক্রমবিবর্তনের ইঙ্গিত। সাদাকালো থেকে রঙিন, সময়ের বিবর্তন, আলো-অন্ধকারের বিপরীতমুখী সংমিশ্রণ। এ ছবিগুলো পাশাপাশি একই জায়গায় বসানো। মুনেম ওয়াসিফ আলাদা করে বসাননি তার ভিন্নধর্মী ছবিগুলো। কেননা পাশাপাশি থাকলেই তার পরিবর্তন স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র, শব্দ, ইনস্টলেশন—শিল্পের প্রায় সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন এবং ক্রমশতে তা রেখেছেন মুনেম ওয়াসিফ। একটা প্রদর্শনী বা একটা স্পেসে নানা মাধ্যম নিয়ে আসা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে মুনেম বলেন, ‘আমার কাজে ভিন্ন ভিন্ন যে মাধ্যম দেখছেন সেটা গত ২৪ বছরে শিল্পী হিসেবে কাজ করতে করতে হয়েছে। আমার কাজগুলো প্রতিনিয়ত আরো উন্নত হয়েছে। এমনকি কাজগুলো আগের থেকে অনেক বিস্তৃত হয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিল্পী হিসেবে আমার ভিতরে বিশেষ বোধ জন্ম নিয়েছে। যেগুলো কেবল কিছু নির্ধারিত মিডিয়ামেই দেখা সম্ভব। আমার প্রথম দিকের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফটোগ্রাফি যদি দেখেন সেটার একটা পার্টিকুলার হিস্টোরিক্যাল ট্রেডিশন আছে। আমার ছবির ভেতরে দেখবেন সাদা কালোর ভিতরে একটা বিশেষ টেক্সচার আছে। ছবিতে অনেকগুলো ঘটনা ঘটছে একসাথে, ছবিতে আমি একটা বিশেষ মুহূর্ত ধরার চেষ্টা করছি। এটা ফটোগ্রাফির একটা ভাষা।
সিনেমাটা যদি দেখেন, সেখানে ফটোগ্রাফি আর মুভিং ইমেজের একটা মিশ্রণ আছে। আমাদের মাধ্যমগুলোরও পরিবর্তন হচ্ছে। আগে আমরা একটা ফটোগ্রাফি ক্যামেরায় যা করতে পারতাম এখন সে ফটোগ্রাফি ক্যামেরা দিয়েই ভিডিও করা যাচ্ছে কিংবা ভিডিও ক্যামেরা দিয়েই ছবি তোলা যাচ্ছে। ফলে এই মিডিয়ামের বিষয়টা গত ১৫-৩০ বছরে সমকালীন শিল্পে অবান্তর হয়ে গেছে। আপনি কোন মিডিয়ামে কাজ করছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। বরং কী বলতে চাচ্ছেন সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ভাস্কর্যের যে কাজগুলো করেছি সেটা আসলে আমি দীর্ঘদিন ধরে ফটোগ্রাফি অবজার্বেশন করছি বলেই সম্ভব হয়েছে। নগরের বিভিন্ন নাগরিক স্থাপত্য, স্থানিক স্বল্পতা, বিশ্বায়নের বিষয়গুলো ধারার চেষ্টা ছিল। ধরুন রাস্তায় অস্থায়ী একটা চায়ের দোকান, অস্থায়ী একটা বিষয়। তো তারও একটা অ্যাসথেটিকস আছে। আমি এই অস্থায়ী স্ট্রাকচার গুলোর ভিতরে যে পোয়েটিক রিফ্লেকশন আছে সেটাকে দেখতে চেয়েছি।’
মূলত এ মাধ্যমগুলো ও তার সহাবস্থান, সংশ্লেষ মুনেম ওয়াসিফের ক্রমশর দর্শনকে দর্শকের কাছে নিয়ে আসে। পুরান ঢাকার গলিতে মুখোমুখি মানুষ ও ঘোড়ার অবস্থান দর্শকের কল্পনা ও বাস্তবকে এক জায়গায় নিয়ে আসে। তার মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করে। খেয়ালের জগতে সুর ও বাস্তবের গলিপথকে একসূত্রে গাঁথে।