গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা দেয় সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা। ১৯২৯-৩৮ সাল পর্যন্ত প্রায় দশকজুড়ে ছিল তার ব্যাপ্তি। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার থেকে যা শুরু হয়, তা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপেও। বেকার হয়ে পড়ে কোটি কোটি আমেরিকান। দেউলিয়া হয় ব্যাংকগুলো। বদলে যায় বৈশ্বিক অর্থনীতির চালচিত্র। ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে পরিচিত সে মহামন্দার প্রভাব পড়েছিল ঔপনিবেশিক যুগের সুদূর বাংলায়ও। সে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খড়গ। ফলে বাংলার জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়ানক অভিজ্ঞতা-মন্বন্তর। বাংলায় ১৩৫০ সালে হওয়ার কারণে যা পঞ্চাশের মন্বন্তর হিসেবেই বেশি পরিচিত।
ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের সম্পদ নিজেদের যুদ্ধপ্রস্তুতিতে ব্যবহার করতে থাকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন চলছে। তবে কমিউনিস্টরা জাতীয় মুক্তির চেয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিরোধকেই বেশি গুরুত্ব দিল। ১৯৪২ সালের সে সময়েই কলকাতার লেখক-শিল্পীদের মাধ্যমে গঠিত হলো ফ্যাসিবাদ লেখক ও শিল্পী সংঘ। রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের পাশাপাশি শিল্প ও আদর্শের ভিত্তি নড়ে উঠেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। শান্ত, সুস্থ ও পরিশীলিত শিল্পবোধ ও ভাবনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন নবীন সাহিত্যিক ও শিল্পী। তারা জীবনের দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে তুলতে শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চয়তা ও মানুষের দুঃখ বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিকদের দ্রুত টেনে নেয় সমাজ-বাস্তবতার আদর্শের দিকে। তারা শিল্পকে করে তুলতে চাইলেন মানুষের সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার। ক্রমে চিত্রশিল্পে প্রাধান্য পেতে থাকল বাস্তববাদ। শিল্পীরা সে গল্প বলতে চাইলেন, যে দৃশ্য তারা চারপাশে দেখে চলছেন। কেবল বিনোদনের সৃষ্টি নয়, শিল্প হয়ে উঠতে থাকল সমাজের প্রতিনিধি।
পঞ্চাশের মন্বন্তর বা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে ভয়াবহ এক অধ্যায়। বিদেশী শাসক আর দেশী মজুদদারদের যোগসাজশে দেশের হাটবাজার শূন্য হয়ে গেল। গরিবদের জীবন হলো দুর্বিষহ। দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামের মানুষ খাদ্যের সন্ধানে গেল কলকাতায়। ‘ফ্যান দাও’, ‘ফ্যান দাও’ হাহাকারে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। এ দৃশ্য বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এল। দলমত নির্বিশেষে তারা এগিয়ে এলেন দেশের মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার অংশীদার হতে। রচিত হলো গান, কবিতা, নাটক, গল্প ও উপন্যাস। শিল্পীরাও পিছিয়ে থাকলেন না। তুলি ধরলেন সে দুর্ভিক্ষের নিদারুণ অভিজ্ঞতাকে ধরে রাখতে। অনাহারে ক্লিষ্ট অস্থিসার মানুষ আঁকলেন দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী ও অতুল বসুর মতো প্রবীণ শিল্পীরা। গোবর্ধন আশ তার বেগমপুরের গ্রামে বসেই আঁকলেন কঙ্কালসার নারী-পুরুষ-শিশুর মর্মস্পর্শী ছবি। অবনী সেন দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদ জানালেন ভয়ংকর জন্তুর প্রতীকী চিত্র এঁকে। নবীন শিল্পীরাও পিছিয়ে থাকলেন না। গোপাল ঘোষ, নীরদ মজুমদার, সূর্য রায়, ইন্দ্র দুগারের মতো শিল্পীরা তুলি আর কলমে দুর্ভিক্ষকে চিত্ররূপ দিলেন। বুভুক্ষু কৃষকদের ছবি আঁকলেন সোমনাথ হোর, শহরের ফুটপাতের মৃত্যু আঁকলেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। এভাবে বাংলার জনমানসে মন্বন্তর যে প্রভাব বিস্তার করল, তা শিল্পীমনে বিস্তৃত হয়েছে।
বাংলার চিরায়ত যে চিত্রকর্মের ধারা, সেটা যেন বাঁক নিতে শুরু করল। প্রবীণ ও নবীন শিল্পীরা নিজেদের মতো করে অবদান রাখতে লাগলেন সে স্রোতে। প্রতীকী তাৎপর্যে দুর্ভিক্ষকে হাজির করলেন নন্দলাল বসু তার অন্নদাতা অন্নপূর্ণার ছবিতে। যামিনী রায় আধুনিক ঘরানার চিত্রশিল্পী; তার পরও তিনি নিশ্চুপ থাকলেন না। তবে সবচেয়ে প্রাণস্পর্শী আর সার্থক ছবি আঁকলেন জয়নুল আবেদিন ও চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য। জয়নুল আবেদিন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে পড়তে যান কিশোরগঞ্জ থেকে। তার শিল্পীজীবনের অনুপ্রেরণা ছিল পূর্ববাংলার প্রকৃতি—বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় বড় নদীর প্রবহমানতা। তাকে একদিকে টানত ব্রহ্মপুত্র নদের বিস্তার আর তার পারাপারের মানুষ, অন্যদিকে সাঁওতাল পরগনার নিসর্গ আর আদিবাসী নারী-পুরুষের ছন্দময় জীবন। দুর্ভিক্ষ যেন তাকে সহজ আনন্দের জীবন থেকে সরিয়ে আনল। দুর্ভিক্ষের শুরুতে তিনি ফিরে আসেন ময়মনসিংহে, কিন্তু মানুষের দুর্দশা সহ্য করতে না পেরে ফের চলে যান কলকাতায়। কিন্তু চাইলেই কি ভাগ্য থেকে পালানো যায়! কলকাতার অবস্থা তখন আরো ভয়াবহ। মানুষের হতাশা আর বেদনা, বুভুক্ষা আর হাহাকার জয়নুলকে বিমর্ষ করে তুলল। তিনি একটি সিরিজ আঁকলেন কালি আর শুকনা তুলির স্কেচে। যুদ্ধের ডামাডোলে ভালো কাগজ ছিল দুর্লভ আর দুর্মূল্য। ফলে সস্তা, হালকা রঙের মোড়কের কাগজে জয়নুল এঁকেছিলেন তার বলিষ্ঠ রেখা। সে স্কেচ বাংলার মহামন্বন্তরের মূল্যবান দলিল। দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো প্রধানত তুলিতে আঁকলেও তার একটি এঁকেছিলেন তেলরঙ আর দুটি ছাপাই পদ্ধতিতে। ছবিগুলো জয়নুলের এতই প্রিয় ছিল যে সেগুলোকে কোনোদিন হাতছাড়া করেননি। দুর্ভিক্ষের মানুষগুলোর প্রত্যেককে তিনি দিয়েছেন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের অভিব্যক্তি; তা খুব স্পষ্টভাবেই আলাদা করা যায়। এজন্যই ১৯৫২ সালে লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে ছবিগুলো দেখে ইংরেজ চিত্রকর এরিক নিউটন মন্তব্য করেন, ‘এগুলোয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এমন এক সমন্বয় দেখা যায়, যা সবাই মনে করেছেন অসাধ্য।’
জয়নুল দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। নেতৃত্ব দেন আধুনিক চিত্রকলার শিক্ষা ও আন্দোলনে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জাতীয় শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন। নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিচরণ করতে হয়েছে তাকে নানা সময়ে, কিন্তু মন্বন্তর তাকে যে দীক্ষায় দীক্ষিত করেছিল, মানবতাবাদের সে দর্শন থেকে তিনি সরে যাননি কোনোদিন।
দুর্ভিক্ষ নিয়ে যারা সরব থেকেছেন, তাদের মধ্যে জয়নুলের পরই সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম চিত্তপ্রসাদ। চিত্তপ্রসাদ প্রথম দিকে ছিলেন বামপন্থী কমিউনিস্ট। নিজে নিজেই শিখেছেন ছবি আঁকা। কোনো আর্ট স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি অর্জন করার সুযোগ পাননি। শিল্পমনীষার জোরেই একটা চিত্রভাষা খুঁজে নিতে দেরি হয়নি তার। সে ভাষা ছিল সহজ কালি-তুলির ভাষা। কালো কালির ব্যবহারে তিনি এমনই সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন যে তার ছবিতে রঙের অভাব বোধ হয় না। শিল্পী হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ যে দুর্যোগের কালে, তখন রঙ ছিল বেমানান। তিনি তার শিল্পীজীবন শুরু করেছিলেন কৃষক-সাধারণের সংগঠিত হওয়ার খবর আর তার ছবি কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক ‘জনযুদ্ধ’-এ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে। ছবি ঠিক প্রচারধর্মী ছিল, তা নয়। তবে ছবিকে তিনি ব্যবহার করেছেন প্রচারমাধ্যম হিসেবে। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি নির্দ্বিধায় লিখেছিলেন, ‘এ যুগে জনতার জীবনের সর্বদিকে সর্বক্ষেত্রেই বণিক-রচিত যত সংকট, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তেজ জাগাতেই প্রয়োজন মনুষ্যদৃপ্ত শিল্পকলার। তেমন বীর্যবান কাজে না লাগলে যে শিল্প যত মধুর ও পবিত্ররসের আধার হোক, সবই আধুনিক জীবনে নিষ্প্রয়োজন বলে অন্তত আপাতত ব্যর্থ অর্থাৎ আধুনিকতার দাবি সে শিল্প করতে পারে না। দুর্ভিক্ষের বছরেও তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছবি এঁকে এনেছেন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। সে ছবি তিনি এঁকেছেন আলোছায়ার দ্বন্দ্বে, কালো কালির যন্ত্রণায়। দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলোয় কলকাতায় বসে তিনি আঁকলেন শ্রমিক-ধর্মঘট আর ছাত্র আন্দোলনের দৃপ্ত সব ছবি। তারপর ১৯৪৬ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজি পত্রিকার জন্য তার বোম্বেতে বসবাস শুরু হয়। সেখানে তিনি আঁকেন ‘নৌ-বিদ্রোহ’ সিরিজ। আরো পরে লিনোকাট ছাপাই ছবিতে রূপ দেন শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের সেসব শিশুকে, যারা আশৈশব খেটে খায়। তাদের প্রেম আর স্বপ্নকে চিত্তপ্রসাদ ফুটিয়ে তুলেছেন পশ্চিম ভারতের লোকচিত্রকলার ঐতিহ্যকে নিজের করে নিয়ে বিশিষ্ট এক চিত্রভাষায়।
জয়নুল আর চিত্তপ্রসাদ মন্বন্তরের চিত্রকর্মের প্রতিনিধিত্বশীল মুখ হলেও সমকালীন অধিকাংশ চিত্রকরকে প্রভাবিত করেছে বাংলার সে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। শিল্পীরা নিজের মতো করেই তুলে ধরেছেন আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে। দিনশেষে শিল্পীরা তো সমাজেরই অংশ।