স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত। সে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়ে পড়ে নানা আঙ্গিকে, নানা পরিস্থিতিতে। অনুভূতি ও বোধকে প্রকাশ করার এই যে তাড়না, এখান থেকেই জন্ম নেয় শিল্প, সাহিত্য ও হরেক কিসিমের শাস্ত্র। স্বাধীনতা জিনিসটা আসলে কী, এ নিয়ে প্লেটো থেকে আজ অব্দি বাহাস রয়েছে বিস্তর। কিন্তু চিত্রশিল্পীদের দায়িত্ব তো ভিন্ন। কঠিন কঠোর তত্ত্ব না, স্বাধীনতার দৃশ্যরূপ হাজির করে দেখাতে হয় তাদের। তুলির আঁচড়ে তুলে ধরতে হয় স্বাধীনতাকে। স্বাধীনতার যেহেতু আবার রকমফের আছে। যেহেতু সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অভিব্যক্তি থেকে জাত স্বাধীনতার দৃশ্যরূপ আলাদা; তাই তাদের চিত্রকর্মের মাধ্যম ও পরিসরে ভিন্নতা দেখা যায়।
স্বাধীনতাকে স্ত্রীলিঙ্গে পাঠ করার প্রবণতা আছে জাতীয় পরিসরে। তার একটা কারণ সম্ভবত নারীর মাতৃরূপ। স্বাধীনতাও তো এক অর্থে জাতীয় ভবিষ্যতের মাতৃরূপ। সম্ভবত এ কারণে প্রায়ই স্বাধীনতাকে কোনো এক নারীর অবয়ব নিয়ে হাজির হতে দেখা যায় চিত্রকলায়। সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই উদাহরণ হলো ইউজিন দেলাকোয়ার আঁকা ‘লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। দুটিই পেয়েছে আইকনিক মর্যাদা। প্রথমটিকে দেখা যায়, ফ্রিজিয়ান ক্যাপ পরিহিত এক নারীকে অনুসরণ করে এগিয়ে ফরাসি বিপ্লবীরা। তাদের হাতে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা ও বন্দুক। সম্মুখের নারীটি স্বাধীনতার রূপক। স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে এক নারীর হাতে ধরা টর্চ। পায়ের কাছে পড়ে থাকা ভাঙা জিঞ্জির। যেন বন্ধন মুক্তিকেই ঘোষণা করছে প্রতিনিয়ত। সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তিকে প্রতিকায়িত করতে দেলাকোয়ার চিত্রকর্মটি মোক্ষম। পরবর্তী সময়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে নারীটি চিত্রকর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নারীই স্বাধীনতা। যেন স্বাধীনতা কেবল জীবন্ত না, স্বাধীনতা বিপ্লবের পথনির্দেশক।
ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাধীনতা বলতে সাধারণত বাক্স্বাধীনতাকেই ইশারা করা হয়। আধুনিক সমাজে উৎপাদিত সবচেয়ে বড় অর্জনের একটি ব্যক্তিস্বাধীনতা। জিম ওয়ারেনের ‘দ্য লিভিং স্ট্যাচু’ এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে চিত্ররূপ দিতে গিয়ে জিম ওয়ারেন একটা স্বতন্ত্র পন্থা অবলম্বন করেছেন। সেখানে টর্চ ধরে রাখা নারীর মুখের একপাশটা মানবিক করে তোলা হয়েছে। যেন ব্যক্তিসত্তার জাগরণ। ব্যক্তিসত্তার জাগরণ অর্থে হলেও এ উপস্থাপনা যথেষ্ট প্রতীকী। তবে অনেক শিল্পীই প্রতীকের ধার ধারেননি। তারা আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীনতাকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সেক্ষেত্রে তাদের চোখে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কারাবন্দি ও দাস। এ রকম একটা চিত্রকর্ম হচ্ছে ওয়াল্টার ক্রেইনের আঁকা ফ্রিডম। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায়, একজন বন্দির সামনে দাঁড়িয়ে ডানাওয়ালা নারী। যেন কারাবন্দিকে তিনি মুক্ত করে নিয়ে যেতে চান দুই বাহুতে। মুক্ত করতে চান দাসত্ব ও বন্দিত্ব থেকে। পাশে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দুই প্রহরী। নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে হাজির হলেও স্পষ্টত একজন বন্দির শৃঙ্খল মুক্তিকে হাজির করা হয়েছে কোনো রূপক ছাড়াই। দাস প্রসঙ্গ এলেই আসে ১৮৪৮ সালে ফরাসি উপনিবেশে দাস মুক্তির ঘোষণার কথা। সেই দিনকে স্মরণ করে ফ্রাসোয়াঁ অগাস্ত বিয়ার্ড এঁকেছেন চিত্রকর্ম ‘ফরাসি উপনিবেশে দাসত্ব বিলুপ্তির ঘোষণা’। দাসদের উচ্ছ্বাসে সেখানে স্বাধীনতা অভাবনীয় এক রূপে ধরা দিয়েছে। স্বাধীনতার সহজ-সরল উপস্থাপন দেখা যায় পিকাসোর তুলিতেও। ১৯২২ সালে আঁকা ‘টু উইম্যান রানিং অন দ্য বিচ’ চিত্রকর্মে তিনি দেখিয়েছেন লাস্যময়ী দুই তরুণী দৌড়াচ্ছে সমুদ্রের সৈকত ধরে।
জাতীয়তাবাদের যুগে স্বাধীনতা বলতে যা বুঝানো হতো, পরবর্তী সময়ে প্রায়ই তার অর্থ পরিবর্তন হয়েছে। ফরাসি বিপ্লব ছিল জাতীয় জাগরণ। ফলে বিপ্লব ও স্বাধীনতা সেখানে ব্যাপক। এর বাইরে গিয়েও স্বাধীনতার আলোচনা প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে। যেহেতু মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা থাকা স্বতন্ত্রভাবে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ফলে সে চিন্তাকে প্রকাশ করার স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে সরব সচেতন মানুষ। এভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ফ্রিডম অব প্রেস প্রসঙ্গ। বিভিন্ন চিত্রশিল্পী মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অঙ্কন করেছেন, সবচেয়ে মোক্ষম উদাহরণ ডাউমিয়েরের আঁকা ফ্রিডম অব দ্য প্রেস। সেখানে এক ব্যক্তিকে আত্মরক্ষার ঢঙে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়; যেন তিনি অধিকার রক্ষা করতে তৎপর। স্বাধীনতা এখানে অনেক বেশি শারীরিক ও মানসিক শক্তির ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে নানা রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি, তাদের সামনে তাদের দিকেই মুখ করে তাকিয়ে মুঠোবদ্ধ এক তরুণ। মত প্রকাশের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কানাডীয় পেইন্টার ফায়ে হলের আঁকা ফ্রিডম চিত্রকর্ম নিয়ে কথা বলাটা অন্যায্য হবে না। ফ্রিডম নামে তার চিত্রকর্মে দেখা যায় এক চিৎকাররত তরুণকে।
দুনিয়ায় হরেক কিসিমের উপায় আছে স্বাধীনতাকে যাপন করার। যাপিত জীবনের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া তাদের মধ্যে একটি। ব্যক্তিস্বাধীনতার পর্যায়েই পড়ে। দল, সমাজ ও প্রথার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের বিশ্বাসের ওপর দৃঢ় থাকাই এখানে বিবেচ্য। এ রকম একটা উদাহরণ মার্টিন পেরেজ ইরাস্তার আঁকা ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড, নট টু’। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায় একজন আরব নারীকে। আসলে একজন না, সেখানে বেশ কয়েকজন আরব নারী। সবাই যেখানে একদিকে যাচ্ছে, সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রের নারীটি চলছে ঠিক ভিন্নদিকে। তার অভিব্যক্তি ও বেশভূষায় স্পষ্ট স্বতন্ত্রতা। যেন পৃথকভাবেই চিহ্নিত হতে চায় সে। যেন সে দাঁড়িয়ে আছে অধিকার নিয়ে আত্মশক্তিতে সচেতন মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে।
অনেক চিত্রশিল্পী আছেন, তারা মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে সচেতন। মার্কসীয় ম্যুরালিস্ট দিয়েগো রিভেরার চিত্রকর্মে মানুষের রাজনৈতিক অধিকারকে দেখা যায়। দিয়েগো রিভেরা মেক্সিকোর সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশ বিরোধিতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অটল মহীরুহের মতো। তার রাজনৈতিক দর্শন প্রভাবিত করেছে ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকলাকেও। এখন পর্যন্ত ফ্রিদা কাহলো ও দিয়েগো রিভেরাকে মেক্সিকান রেনেসাঁর পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা দুজনেই স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন। সেটা ব্যক্তিস্বাধীনতাই হোক কিংবা রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে আলাদাভাবে পাঠ করা যায় দিয়েগো রিভেরার ‘ল্যান্ড অ্যান্ড ফ্রিডম’ চিত্রকর্মটি। সেখানে কেবল স্থানীয় সংস্কৃতিকে হাজির করাই তার উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবাদকেও চিত্রিত করা। এভাবে দেলাকোয়া থেকে দিয়েগো রিভেরা পর্যন্ত স্বাধীনতাকে দৃশ্যরূপ দেয়ার ঐতিহ্য পেয়েছে বহুমাত্রিকতা। সে ঐতিহ্যে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নামও। হবেই—বা না কেন? দিনশেষে মানুষ নিজেই তার স্বাধীনতার ঘোষক।